খাল দখল করে মাছের খামার

  • খালে একাধিক বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে জোয়ার-ভাটায় ব্যাঘাত ঘটছে।

  • শীতে খালের পানি কয়েক ইউনিয়নের কৃষক ব্যবহার করতেন, যা এখন পারছেন না।

ভোলার চরফ্যাশনে মাইনুদ্দিনের খালে একাধিক বাঁধ দিয়ে দখল করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। সম্প্রতি উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে
ছবি: প্রথম আলো

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আবদুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আল এমরানের (প্রিন্স) বিরুদ্ধে খাল দখল করে একাধিক আড়াআড়ি বাঁধ টেনে মাছের খামার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে উন্মুক্ত ওই জলাশয় বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এর জেরে কয়েক দিনের বর্ষায় এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। খালটিতে আগে জোয়ার-ভাটা হতো, সেটিও মাছের খামারের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। আল এমরান চরফ্যাশন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্যপদে রয়েছেন।

শুধু তা-ই নয়, ওই খালে পানি শুকিয়ে ড্রেজার বসিয়ে দুই মাস ধরে (এপ্রিল-জুন) আশপাশের মানুষের কাছে মাটি বিক্রি করেছেন চেয়ারম্যান। গভীর করে মাটি উত্তোলনের কারণে জলাশয়ের দুই পাশের বসতঘর ও সড়কে ফাটল সৃষ্টিসহ সড়কের ঢাল ধসে পড়ছে। স্থানীয় লোকজন ক্ষতিপূরণ দাবি করে ওই ড্রেজার জব্দ করেন। তখন চেয়ারম্যানের লোকজন ধস ঠেকাতে ড্রেজার তুলে নিয়ে খামারটি পানিপূর্ণ করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সড়ক সংস্কার করে দিয়েছেন।

দখলকারী ইউপি চেয়ারম্যান আল এমরান চরফ্যাশন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্যপদে রয়েছেন।

খালটি মাইনুদ্দিনের খাল বা স্থানীয়ভাবে মাইনুদ্দিনের দোন নামে পরিচিত। খালের অবস্থান উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে। মেঘনা নদী থেকে উঠে আসা মাইনুদ্দিন খাল এঁকেবেঁকে আবার মেঘনায় মিশেছে। এর সঙ্গে আরও কয়েকটি শাখা খাল আছে।

হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (ব্লক সুপারভাইজার) জয়ন্ত মজুমদার বলেন, বর্ষাকালে হাজারীগঞ্জের পানি মাইনুদ্দিন খালে নামে। আর শীতে খালের পানি কয়েক ইউনিয়নের কৃষক ব্যবহার করতেন। এখন খালের মধ্যে বাঁধ দিয়ে বদ্ধ জলাশয় বানিয়ে মাছ চাষ করায় এলাকাবাসী খালের সুফল ভোগ করতে পারছেন না।

চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আল এমরান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁকে আপনারা খাল বলছেন, সেটি আসলে কোনো খাল নয়। এটা একটি মৎস্য খামার। একটি নয়, পাঁচটি খামার। ১৯৯৫ সাল থেকে আমি খামারে মাছ চাষ করে আসছি। খামারের দুই পাড়ের জমি আমার, ভেতরের বন্দোবস্তকৃত জমি আমার। আশপাশে যাঁরা বন্দোবস্ত পেয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে কিনেছি। খামারের দুই পাশের সব জমি আজ থেকে ৩০ বছর আগে থেকে আমার পৈতৃক সম্পত্তি।’

আল এমরান আরও বলেন, ‘মৎস্য অধিদপ্তরের এফসিডিআই প্রকল্পের অর্থায়নে বিগত সময়ে খামারে মাটির কাজ করেছি। এ বছর খামারগুলো মাটিতে ভরে গেছে, যে কারণে খনন করা দরকার ছিল। মাটি কাটব, এ কারণে ড্রেজার বসিয়েছি। এত মাটি কোথায় ফেলব, তাই মাটি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন কারা আমার পেছনে ষড়যন্ত্র করছে, জানি না।’ এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাটি কাটার কারণে ঘরবাড়ি নয়, রাস্তা ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি পাইলিং করে সংস্কার করে দিচ্ছি। যাঁরা বলছেন ঘর ভাঙছে, তাঁরা মিথ্যা বলছেন।’

চরফ্যাশন উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার বলেন, খালের মধ্যে বাঁধ দিয়ে বদ্ধ জলাশয় বানানো হয়েছে। তিনি শুনেছেন, বদ্ধ জলাশয়টি পাউবোর বাঁধের ফলে সৃষ্ট একটি কৃত্রিম জলাশয়। সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে চেয়ারম্যান মাছ চাষ করছিলেন, যার আয়তন প্রায় সাড়ে ৩ হেক্টর। পরে ২০০৮ সালে প্রায় দুই লাখ টাকায় মৎস্য অধিদপ্তরের সমন্বিত মৎস্য চাষ উন্নয়ন প্রকল্প (এফসিডিআই) থেকে ওই জলাশয়ের উন্নয়ন করে। ওই প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ৩ বছর। সেসব এখন অতীত। এখন এর কোনো নথিও নেই।

স্থানীয় লোকজন ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে মাইনুদ্দিন খালটি বয়ে গেছে। প্রবহমান এই খালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তজুমাঝির হালোটের কাছে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করায় খালটি দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে খালের একটি ভাগে বাঁধ দিয়ে দখল করে চেয়ারম্যান আল এমরান মাছ চাষ শুরু করেন। ২০০৮ সালে মৎস্য অধিদপ্তরকে অসত্য তথ্য দিয়ে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প এনেছিলেন তিনি। ওই প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও চেয়ারম্যান খালের দখল ছাড়েননি।

ভোলা পাউবো-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, মধ্য দিয়ে বন্যা-জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চলে যাওয়ার কারণে খালটি দুই ভাগ হয়েছে সত্য, তবে খালের দুই মাথা মেঘনায় মিশে থাকার কারণে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হতো এবং নাব্যতার হ্রাস ঘটেনি। তবে বর্তমানে খালের মধ্যে আড়াআড়ি একাধিক বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে জোয়ার-ভাটায় ব্যাঘাত ঘটছে।

এলাকাবাসী জানান, মেঘনার ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো কয়েক শ পরিবার মাইনুদ্দিনের খালের দক্ষিণ তীরে বসবাস করছেন। চিকন খালের মুখে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের কারণে এবং গভীর খনন করার কারণে খালের দুই পাশের প্রশস্ততা যে হারে বাড়ছে, তাতে অসহায় পরিবারগুলোর বসতবাড়ি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শীতে পানি কমে এলে দুই পাড় আবার বিধ্বস্ত হবে। কোনো দুর্যোগ এলে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় নকশা অনুযায়ী খাল পুনরুদ্ধার দরকার।

জানতে চাইলে চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল নোমান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, খাল দখলের অভিযোগ সত্য কি না, তা তিনি সরেজমিনে পরিদর্শন করে তদন্ত করবেন। খালটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।