নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়ায় হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নড়াইল জেলাকে লজ্জায় ফেলেছে। এ ঘটনায় চোর-ডাকাত-দুর্বৃত্ত চক্র ঢুকে পড়েছিল। প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের তৎপরতায় হামলার ব্যাপকতা বাড়েনি।
শনিবার বিকেলে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
জেলা পুলিশের আয়োজনে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় অংশীজনদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা রেঞ্জের উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খ. মহিদ উদ্দিন। পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়ের সভাপতিত্বে সভায় অতিরিক্ত ডিআইজি মো. নজরুল ইসলাম, জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।
সভায় লোহাগড়া উপজেলা চেয়ারম্যান শিকদার আবদুল হান্নান বলেন, ধর্ম অবমাননার সুযোগ নিয়ে চোর-ডাকাত-দুর্বৃত্ত চক্র লুটপাটের চেষ্টা করেছিল। তারা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা করে। কিন্তু পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের তৎপরতায় এর ব্যাপকতা বাড়েনি। অন্যথায় এটা পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ত। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বোস বলেন, এ ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নড়াইলকে লজ্জায় ফেলেছে।
দিঘলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলীপ সাহার বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছিল। সভায় তিনি বলেন, হামলা ও লুটপাট চলে ৩০–৪০ মিনিটের মতো। সঙ্গে সঙ্গে এলাকার মানুষ এসে পাশে দাঁড়ান। আর যেন এমন না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, প্রশাসন শক্তিশালী অবস্থান নেওয়ায় দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
শেষে ডিআইজি খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, এস এম সুলতান, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়ি এই নড়াইলে। এ জেলার হাজার বছরের সম্প্রীতির ঐতিহ্য আছে। নড়াইলে এ হামলা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বড় ঘটনা ঘটেনি। সাহাপাড়ায় যা ঘটেছে, তাতে সম্পদের চেয়ে মনের ক্ষতি হয়েছে বেশি। নবীজিকে যাঁরা কটূক্তি করেছেন, তাঁরাও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনের ক্ষতি করেছেন। হামলায় জড়িত ব্যক্তিরাই গ্রেপ্তার হচ্ছেন।
লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আবু হেনার সঞ্চালনায় লোহাগড়া পৌর মেয়র সৈয়দ মশিয়ূর রহমান, জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি অশোক কুণ্ডু, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
ঘটনাস্থলে বিএনপির তদন্ত কমিটি
এদিকে শনিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় বিএনপি গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বেলা সাড়ে ১১টায় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত গোবিন্দ সাহা ও দিলীপ সাহার বাড়িতে যান। পরে সাহাপাড়ার রাধাগোবিন্দ মন্দিরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির প্রধান দলটির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, তা খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। ৪০-৪৫ মিনিট ধরে তাণ্ডব চলেছে। কিন্তু তখন পুলিশ ছিল। এটা প্রশাসনের ব্যর্থতা, সরকারের ব্যর্থতা। নড়াইলের মতো রামু, নাসিরনগরসহ দেশের অন্যান্য এলাকায়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটে।
নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে বিএনপি সাত সদস্যের কমিটি করেছে। আমরা তদন্তের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেছি। সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গেও কথা বলা হবে। এরপর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে দলের পক্ষ থেকে তা প্রকাশ করা হবে।’
এ সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অনিন্দ ইসলাম, জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু, আইনজীবী ফাহিমা নাসরিন, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, অমলেন্দু অপু ও নিপুন রায় চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
উদীচীর বিক্ষোভ সমাবেশ
শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাম্প্রদায়িক হামলা ও নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে নড়াইলে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে উদীচী। গতকাল বিকেলে উদীচীর জেলা সংসদের ব্যবস্থাপনায় শহরের শেখ রিজেন্সি গেস্ট হাউজ মিলনায়তনে এ সমাবেশ করা হয়। সংগঠনটির নড়াইল জেলা সভাপতি মায়া রানী বিশ্বাসের সভাপতিত্বে সমাবেশে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
বক্তারা বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ঘটনা ঘটছে, এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জড়িত। পুলিশ প্রশাসন সেখানে যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। এ পরিস্থিতিতে মুক্তধারার সাংস্কৃতিক জাগরণ ছাড়া মানুষের মুক্তি সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তি করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার জেরে ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। তখন একটি মন্দির ভাঙচুর করা হয়। হামলা হয় পারিবারিক মন্দিরেও। এর আগে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া অভিযুক্ত তরুণের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন তাঁরা। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিপেটা করে ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। রাত সাড়ে নয়টার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।