ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে চাওয়া হয় তিন লাখ টাকার চাঁদা

খাদ্য পরিদর্শক সুশান্ত কুমারকে দুর্বৃত্তরা অপহরণের পর রোবরার রাতে তাঁকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীনছবি: প্রথম আলো

অস্ত্রের মুখে ঝুপড়ি ঘরে আটকে রেখে তিন লাখ টাকার বেশি চাঁদা দাবি করা হয়েছিল খাদ্য পরিদর্শক সুশান্ত কুমার মজুমদারের কাছে। অপহরণের সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর গতকাল রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে খুলনার তেরখাদা উপজেলার আজগড়া বিআরবি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় খুলনা সদর থানায় সাতজনকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। পুলিশ মামলার দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে।

সুশান্ত কুমার মজুমদার এখন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন। আজ সোমবার দুপুরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সুশান্ত মজুমদারের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারধরের চিহ্ন স্পষ্ট। বাঁ চোখের নিচে ফুলে আছে, চোখে ও পায়ে কালচে দাগ।

আরও পড়ুন

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সুশান্ত কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকজন জাপটে ধরে আমাকে একটি ট্রলারে তোলে। এরপর মারধর শুরু করে। ট্রলারটা ভৈরব নদের জেলখানাঘাট পার হয়ে আঠারোবাকি নদীতে ঢোকার কিছু দূর গেলে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে চোখ বেঁধে রাখে, পরে খুলে দেয়। তবে শরীর পা দিয়ে চেপে রাখা হয়েছিল। এরপর একটা ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে যায়। অস্ত্র ঠেকিয়ে আমার কাছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা চায়। পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে বলে। স্ত্রীর নম্বর ছাড়া আর কারও নম্বর মুখস্থ ছিল না। সেই নম্বরে ফোনে কল ঢুকছিল না। পরে ওদের বলে, ঘাটের সোহাগ নামের এক ঠিকাদারের নম্বরে ফোন দিয়ে টাকার কথা বলি।’

সুশান্ত কুমার মজুমদার আরও বলেন, ‘একপর্যায়ে ওরা বলে, কিছু টাকা আসছে, আর এখানে রাখার দরকার নেই। তারপর আমাকে মোটরসাইকেলে তোলে, চোখ বেঁধে, মুখে ন্যাকড়া গুঁজে দিয়ে হেলমেট পরায়। তখন দুই পাশে পিস্তল ঠেকানো ছিল। কোথায় যেন নিয়ে গিয়ে একটা স্কুলের সিঁড়ির পাশে বসিয়ে রাখে। আমি জল পিপাসার ইশারা দিলে ওরা মুখ খুলে দেয়। এরপর বলে, “তোর লোক শয়তানি করছে, টাকা দিচ্ছে না”। টাকা আসতে দেরি হওয়ার কথা বলে মারধরও করে। এর মধ্যে আমার বিকাশের পাসওয়ার্ড নিয়ে ২০ হাজার টাকা তুলে নেয়। একসময় পুলিশ আসার সন্দেহে আমাকে ফেলে চলে যায়। তবে আমি কাউকে চিনিনি।’

সুশান্ত কুমার জানান, আগে একদিন রেজা নামের একজন তাঁর কাছ থেকে ব্ল্যাকমেল করে চার হাজার টাকা নিয়েছিল। গতকালকের ঘটনার সঙ্গেও রেজার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা তাঁর। তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া বাবু নামের একজন কিছুদিন ধরে আমাকে কল দিয়ে নানান কথা বলে। গত শুক্রবার সে তার এক লিডারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল।’

এর আগে রোববার সন্ধ্যা সাতটার দিকে খুলনা নগরের চার নম্বর ঘাট এলাকা থেকে সুশান্তকে তুলে নেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকজন ব্যক্তি তাঁকে জোর করে একটি ট্রলারে তুলে নেন। এ সময় এক পথচারী মুঠোফোনে ঘটনার ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি ধস্তাধস্তির মধ্যে এক ব্যক্তিকে ট্রলারে তোলার চেষ্টা করছেন। ওই সময় তাঁর গোঙানির শব্দ ও চিৎকার শোনা যায়। এরপর ট্রলারটি দ্রুতগতিতে চলে যায়।

সুশান্তর বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারীতে। চার মাস আগে সুশান্ত খুলনায় বদলি হয়ে আসেন। এর আগেও একসময় ঘাটে চাকরি করেছিলেন। কারও সঙ্গে সুশান্তর কোনো বিরোধ ছিল না দাবি করে তাঁর স্ত্রী মাধবী রানী মজুমদার জানান, অপহরণকারীদের নির্দেশে প্রথমে তাঁর স্বামীর এক পরিচিত ব্যক্তি ২০ হাজার টাকা পাঠান। পরে আরও ২৫ হাজার পাঠানো হয়। তবে এর আগেই পুলিশ উদ্ধার করায় সেই টাকা অপহরণকারীরা তুলতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি, রেজা ও বাবু নামের দুজন এর আগেও একদিন চাঁদা চেয়েছিলেন। সে অনুযায়ী থানায় অভিযোগ করি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেজা তেরখাদার শেখপুরা এলাকার বাসিন্দা। সম্প্রতি তিনি এলাকায় বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ঘটনার বিষয়ে খুলনা পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেজার বাড়ি তেরখাদায়, এর আগেও তিনি সুশান্ত মজুমদারের কাছে চাঁদা চাইতে গিয়েছিলেন। তখন কিছু টাকা নেন এবং জেলা যুবদলের একজন শীর্ষ নেতা ও বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে নিজের ছবি দেখান। পরে আবার চাঁদা চাইতে গেলে সুশান্ত রাজি না হওয়ায় তুলে নিয়ে যান।’

বিষয়টি নিয়ে খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার সানওয়ার হোসাইন (মাসুম) প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণের খবর পাওয়ার পর পুলিশের একাধিক ইউনিট অভিযান চালায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে অপহরণকারীরা সুশান্তকে বিদ্যালয়ের মাঠে ফেলে রেখে যায়। পরে তেরখাদা থানার সহায়তায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সাতজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার পেছনের কারণ ও জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে তদন্ত চলছে।