হাওর আন্দোলনের নেতার সাক্ষাৎকার

ব্যক্তিগত লাভ বা কাউকে খুশি করতে হাওরে প্রকল্প নেওয়া বন্ধ করতে হবে

সুনামগঞ্জের হাওরে এখন সবুজ ধানের সমারোহ। এবার জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন। হাওরের এই ফসল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ২০৪ কোটি টাকা প্রাক্কলন ধরে ১ হাজার ৬৩টি প্রকল্পে ৭৪৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে। কিন্তু সুনামগঞ্জ ও ভারতের মেঘালয়ে গত কয়েক দিন বৃষ্টি হয়েছে। তাই জেলার নদ-নদীতে পানি বেড়েছে। এতে কিছু কিছু বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার শুরুতেই বিরূপ আবহাওয়া কিছুটা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে কৃষকের মনে। হাওরের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন হাওর বাঁচাও আন্দোলন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান।

আবু সুফিয়ান
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কদিন বৃষ্টি হলো, আকাশে এই মেঘ এই রোদ, হাওরের সর্বশেষ অবস্থা বলেন।

আবু সুফিয়ান: বৃষ্টি এই সময়ে দরকার ছিল। কিন্তু একটু বেশি হওয়ায় সমস্যা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় ফসল রক্ষা বাঁধে ঘাস লাগানো না হওয়ায় সেগুলোতে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। কোথাও মাটি ধসেছে। তবে এগুলো সংস্কার হচ্ছে। যেসব বাঁধে ঘাস লাগানো হয়নি, সঠিকভাবে দুরমুশ করা হয়নি, সেগুলোর বিল দেওয়া যাবে না।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এবার শুরুতেই বিরূপ আবহাওয়া, ফসলের ঝুঁকি কতটুকু?

আবু সুফিয়ান: বৃষ্টি হয়েছে, নদ-নদীতে পানি কিছুটা বেড়েছে, কিছু বাঁধ ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস এখনো আমাদের পক্ষে। সমস্যা বেশি হয় উজানের বৃষ্টিতে। মেঘালয়ে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢল নামে। গত বছর যেটা এপ্রিলের শুরুতেই হয়েছিল। এভাবে ঢল নামলে তো বিপদ। তাই সতর্ক থাকতেই হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ফসল রক্ষা বাঁধের সর্বশেষ অবস্থা বলুন।

আবু সুফিয়ান: অবস্থা মন্দ নয়। কিন্তু আবহাওয়ার ওপর তো ভরসা নেই। বৃষ্টি হলে পানি বাড়বে, ঢল নামবে। এতে ঝুঁকি তৈরি হবেই। তবে এখন প্রতিটি বাঁধে নজরদারি, তদারকি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বাঁধে পাহারা বসাতে হবে। জরুরি সংস্কারে যেসব সামগ্রী দরকার, সেগুলো এখনই বাঁধে নিয়ে মজুত করে রাখতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাঁধের কাজ শেষ, নাকি এখনো চলছে?

আবু সুফিয়ান: কাজের নির্ধারিত সময় তো শেষ হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর আরও এক সপ্তাহ সময় বাড়ানো হয়। তবে মূল কাজ শেষ। দু-একটি স্থানে কাজ চলছে। এর মধ্যে চাপতির হাওরে একটি প্রকল্প আছে। কিছু কিছু বাঁধে ঠিকমতো দুরমুশ করা হয়নি, ঘাস লাগানো হয়নি। এখন তো ঘাস লাগিয়ে লাভ নেই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এবার বরাদ্দ ও প্রকল্প দুটিই বেশি। বাঁধের কাজ নিয়ে আপনার সংগঠন সন্তুষ্ট?

আবু সুফিয়ান: সুনামগঞ্জের মানুষের বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। এটাই হাওরে প্রধান ফসল। জেলার ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে এই ধান হয়। এই ধান না পেলে হাওরের কৃষক পরিবারে কষ্টের সীমা থাকে না। পুরো এক বছরের সংসার খরচ, সন্তানের লেখাপড়া, বিয়েশাদি—সব নির্ভর করে এই বোরো ধানের ওপর। তাই কৃষকের গোলায় ধান উঠলেই আমরা সন্তুষ্ট। এর আগে সন্তোষ প্রকাশ করার সুযোগ নেই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ধান কাটা কবে শুরু হবে?

আবু সুফিয়ান: ধানে চাল আসছে, তবে সব হাওরে নয়। যেগুলো আগাম জাত সেগুলোতে। ধান পাকা এবং কাটা শুরু হতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন লাগবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: হাওরের ফসল ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কোন কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করা উচিত?

আবু সুফিয়ান: এটা হলো নদী খনন। হাওর এলাকায় থাকা পাহাড়ি নদ-নদী, সুরমা নদী খনন জরুরি। উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলের পানি যদি নির্বিঘ্নে ভাটিতে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যায়, তাহলেই ফসল ঝুঁকিমুক্ত থাকবে। কিন্তু এখন নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় পাহাড়ি ঢল নেমেই হাওরে ঢুকে পড়ে। এতে ফসল তলিয়ে যায়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এই যে হাওরে প্রতিবছর এত এত বাঁধ দেওয়া হয়, এতে হাওরে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না?

আবু সুফিয়ান: অবশ্যই পড়ছে। এত এত মাটি বর্ষায় তো হাওরে, নদীতে যায়। নদী, হাওর ভরাট হচ্ছে। এবারই বাঁধের জন্য মাটি পাওয়া যায়নি। আগামী বছর এই সংকট আরও বাড়বে। বাঁধ কমাতে হবে। কারও ব্যক্তিগত লাভ, আর কাউকে খুশি করার জন্য প্রকল্প নেওয়া বন্ধ করতে হবে। এ জন্য আগে থেকেই সমীক্ষা করে প্রকল্প নিতে হবে। এসব কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।