বিলের মধ্যে রাস্তা তৈরি নিয়ে জেলে ও কৃষকেরা মুখোমুখি

বিলে কয়েক হাজার বিঘা কৃষিজমি রয়েছে। সেখানে ধান, পাট, শর্ষে, সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ হয়।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর জগন্নাথপুর ইউনিয়নের জোতপাড়া বিলে নির্মাণাধীন রাস্তা দিয়ে ফসল ঘরে তুলছেন কৃষক। গত রোববার
ছবি: প্রথম আলো

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী জগন্নাথপুর ইউনিয়নের জোতপাড়া বিলে রাস্তা তৈরি নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে জেলেদের বিরোধ দেখা দিয়েছে। রাস্তা না থাকায় কৃষকেরা ফসল তুলতে যুগের পর যুগ ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। এদিকে রাস্তার মাধ্যমে বিলের মধ্যে বাঁধ দিলে ইজারা নেওয়া জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে জানিয়েছেন। বাঁধের কাজ বন্ধের জন্য তাঁরা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জোতপাড়া বিলে (স্থানীয়ভাবে কোল বলে) শতাধিক কৃষকের কয়েক হাজার বিঘা কৃষিজমি রয়েছে। সেখানে ধান, পাট, শর্ষে, সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ হয়। বিলের ভেতর দিয়েই চলাচল করেন জগন্নাথপুর, চর জগন্নাথপুর, হোগলা, চর মহেন্দ্রপুর ও পার্শ্ববর্তী পাবনা জেলারও কয়েকটি গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ। বর্ষা মৌসুমে নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে কাদামাটিতে হেঁটে চলাচল করেন তাঁরা। মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে জগন্নাথপুর চরে মাটি ফেলে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, উন্নত যোগযোগব্যবস্থা না থাকায় মাঠেই ধান কেটে মাড়াই করেন তাঁরা। ভোগান্তি কমাতে তাঁরা বিলে রাস্তা নির্মাণ করছেন। সরকারিভাবে সেখানে প্রায় তিন কিলোমিটার পাকা বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ করার দাবি জানান তাঁরা।

কিন্তু স্থানীয় জেলেরা বলছেন, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রায় শতাধিক একর জমিতে পদ্মা নদীর বিলে প্রাকৃতিক মাছের অভয়াশ্রম রয়েছে। প্রশাসনকে প্রতিবছর নির্ধারিত রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে তাঁরা ভোগদখল করেন। সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা হলে মাছের অভয়াশ্রমে বিঘ্ন ঘটবে।

গত রোববার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের সড়কের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদীর বিল। সেখানে শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজ হয়। বর্ষা মৌসুমে হয় মাছ চাষ। এখন সেখানে ধান, পাট, সবজিসহ নানান ফসল চাষাবাদ করা হয়েছে। কৃষকেরা পাকা ধান কেটে জমিতেই মাড়াই করছেন। কৃষিজমি ও বিলের মাঝ দিয়ে কয়েক শ মিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সেই বাঁধের ওপর দিয়ে ধান ও খড় মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ হেঁটে চলাচল করছেন।

এ সময় হোগলা গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন, বিলে তাঁর তিন বিঘা কৃষিজমি আছে। সেখানে তিনি ধানের চাষ করেছেন। চলাচলের সড়ক না থাকায় তিনি জমিতেই ধান মাড়াই করে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছেন। জগন্নাথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে চর জগন্নাথপুর গ্রাম পর্যন্ত পাকা বাঁধ ও সড়ক নির্মাণ করলে সবাই উপকৃত হবেন।

মিজানুর রহমান হান্নান নামের আরেক কৃষক বলেন, সেখানে দুই–তিন হাজার বিঘা জমিতে ধান, পাট, সবজিসহ নানান ফসলের চাষাবাদ করেন তাঁরা। কিন্তু ফসল ঘরে তোলার মতো সড়ক ব্যবস্থা নেই। পানির সময় নৌকা আর খরার সময় হেঁটে চলেন তাঁরা।

তবে স্থানীয় কৃষকদের দাবির বিপরীতে জগন্নাথপুর কোল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড। প্রায় ২০০ জেলে এর সঙ্গে জড়িত। প্রতিবছর বিল ইজারা দেওয়া হয়। চলতি মৌসুমে প্রায় দেড় লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছে এই সমিতি। প্রায় ৮৮ একর জায়গাজুড়ে জলমহাল। সম্প্রতি মাটি দিয়ে অন্তত সাড়ে ৩০০ মিটার এলাকাজুড়ে সড়ক তৈরি করা হয়েছে।

৮ মে জগন্নাথপুর কোল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আবদুল বারেক জোয়ার্দ্দার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, পাঁচ বছর ধরে তাঁরা জলমহাল ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করে আসছেন। কিন্তু এ বছর সাবেক ইউপি সদস্য কালাম হোসেন স্থানীয় লোকজন সঙ্গে নিয়ে বাঁধ নির্মাণ করে জলাশয়ে বাধা সৃষ্টি করছেন।

জেলেদের অভিযোগ অস্বীকার করে জগন্নাথপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য কালাম হোসেন বলেন, মানুষের চলাচলের জন্য চাঁদা তুলে সবাই মিলে রাস্তা নির্মাণ করছেন। এতে জেলেদের মাছ চাষে কোনো বাধা হবে না। জনস্বার্থে পদ্মা নদীর বিলে প্রায় তিন কিলোমিটার বাঁধ, পাকা সড়ক ও একটি ছোট সেতু নির্মাণ করার দাবি জানান।

জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল বাকী বলেন, জলমহাল স্থানীয় জেলে সমিতির সদস্যরা ইজারা পেয়েছেন। জলমহালের ওই পারে (চর জগন্নাথপুর) তাঁর একটি ওয়ার্ডের বাসিন্দা রয়েছে। তাঁদের চলাচলের জন্য সবাই মিলে রাস্তা করা হচ্ছে। এতে জলমহালের কোনো সমস্যা হবে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউএনও বিতান কুমার মণ্ডল বলেন, জেলেদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসি ল্যান্ড ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বর্তমানে বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ রয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।