আইলা এসে আমাদের সব শেষ করে দিয়ে গেছে

কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হাজতখালী এলাকায় কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের ঢালে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন রবিউল সরদার ও রাশিদা বেগম দম্পতি
ছবি: প্রথম আলো

‘সেদিন সকাল থেকে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ছিল, গুমোট আবহাওয়ায় একটি গাছের পাতাও নড়ছিল না। প্রতিদিনের মতো মাছের ঘেরে কাজ করছিলাম। দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ ১০-১২ ফুট উঁচু পানির ঢেউ এসে লন্ডভন্ড করে দিল সব। সেদিন সেই পানির মধ্য থেকে কীভাবে যে বেঁচে গেছি, তা একমাত্র ভগবান জানেন।’

১৪ বছর আগের ঘূর্ণিঝড় আইলার দুঃসহ স্মৃতিচারণা করে কথাগুলো বলছিলেন খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা রণজিৎ মণ্ডল। ২০০৯ সালের ২৫ মের কথা মনে পড়লে এখনো আঁতকে ওঠেন তিনি।

রণজিৎ মণ্ডল আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে শাকবাড়িয়া নদীর ঢেউ দেখছেন, এখানেই ছিল আমার ঘর। কাজকর্ম করে তখন ভালোই দিন কাটছিল। আইলা এসে আমাদের সব শেষ করে দিয়ে গেছে। আমার পৈতৃক ভিটার জমি এখনো বাঁধের বাইরে। ১৪ বছর পার হয়ে গেছে। এখনো সেখানে প্রতিদিন জোয়ার-ভাটা চলছে। আগের বেড়িবাঁধের জায়গায় বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় সেই জমি আর উদ্ধার হয়নি। বর্তমানে রিং বাঁধের পাশের ঢালে ঘর করে বসবাস করছি।’

১৪ বছর আগের এই দিনে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত করেছিল বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলে। সুন্দরবনের কোলে গড়ে ওঠা কয়রা উপজেলা সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেদিন পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭টি পয়েন্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে উপজেলার বেশির ভাগ অংশ লোনাপানিতে তলিয়ে যায়। এই দুর্যোগে শুধু কয়রা উপজেলাতেই ৪৩ জনের মৃত্যু হয়। আইলার আঘাতের পরের বছর উপজেলার অধিকাংশ এলাকার বেড়িবাঁধ মেরামত করে নদীর লোনাপানি আটকানো গেলেও উপজেলার মহারাজপুর, কয়রা সদর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন প্রায় সাড়ে তিন বছর লোনাপানির নিচে ছিল। গোটা এলাকা হয়ে পড়েছিল সবুজহীন। পরে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো কোনোরকমে মেরামত করা হলেও শক্ত বাঁধ তৈরি হয়নি। ফলে এখনো অনেক জায়গা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

আইলার সময় শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে দক্ষিণ মঠবাড়ী গ্রামকে ভাগ করে একটি খাল তৈরি হয়েছিল। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় লোকজন এখনও ড্রামের ভেলায় চড়ে ওই খাল পাড়ি দেন
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি সুন্দরবন–সংলগ্ন উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এক যুগেরও বেশি সময় পার হলেও আইলার অনেক বড় বড় ক্ষত এখনো দৃশ্যমান।

কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী, দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের হারেজখালী, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি এলাকায় আইলার আঘাতে লোকালয়ের মধ্য দিয়ে নদীর স্রোতের তোড়ে তৈরি হওয়া খালগুলোতে এখনো পানি থই থই করছে। মহারাজপুর ইউনিয়নের পবনা এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙার কারণে দক্ষিণ মঠবাড়ী গ্রামকে দুই ভাগ করে একটি খাল তৈরি হয়েছিল আইলার সময়। শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় লোকজন এখনও ড্রামের ভেলায় চড়ে ওই খাল পাড়ি দেন।

এ ছাড়া উপজেলার পাথরখালী এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন আইলায় গৃহহারা ২২টি পরিবার। কয়রা সদরের সোনাপাড়া এলাকায় ৫০টি পরিবার বাঁধের ওপরেই থাকছে। সুতির অফিস এলাকা থেকে মঠবাড়িয়া বেড়িবাঁধের ওপর বাস্তুহারা মানুষের সারি সারি বসবাস চোখ এড়ায় না।

আইলার আঘাতের পর থেকে ১৪ বছর ধরে গাববুনিয়া গ্রামের কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের ঢালে বাস করছেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ ফুলবাসি মণ্ডল। আইলার ভোগান্তির বর্ণনা দিয়ে ফুলবাসি বলেন, জোয়ারের সময় গ্রামের সবার সঙ্গে রাস্তায় তিনি উঁচু স্থানে গিয়ে অপেক্ষা করতেন। আবার ভাটায় পানি নেমে গেলে ঘরে ফিরতাম। টানা দেড় বছর ধরে ঠিকমতো কেউ রান্না, খাওয়াদাওয়া করতে পারতেন না।

কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের মজিবুর রহমান বলেন, তাঁর এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা এখনও  নাজুক। অসংখ্য মানুষ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোজাফফর হোসেন বলেন, আইলার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো উপকূলীয় জনপদের মানুষের যাতায়াতব্যবস্থা খুবই নাজুক। বর্ষার দিনে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের মানুষের নৌকা ও ট্রলারই একমাত্র ভরসা। আইলার পর এই এলাকা দীর্ঘদিন লোনাপানিতে তলিয়ে থাকায় এখানে কৃষিজমি কমে গেছে। তাই এলাকাজুড়ে কাজের সুযোগ কমে গেছে। অনেকেই তখন বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়েছেন। যাঁদের অধিকাংশই আজও তাঁদের বসতভিটায় ফিরে আসতে পারেননি।

মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য উত্তম মণ্ডল বলেন, এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। সবার ধারণা, এবারের বর্ষা মৌসুমে মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কয়েকটি জায়গার বেড়িবাঁধ টিকবে না। আইলা বিধ্বস্ত উপকূলে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আমাদের দাবি ছিল—পরিকল্পিত বাঁধ চাই, জীবন-জীবিকা ও সম্পদের নিরাপত্তা চাই। তবে আইলার পর ১৪ বছর অতিবাহিত হলেও আমাদের দাবি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।’

আইলার আঘাতের পর থেকে ১৪ বছর ধরে কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের ঢালে বাস করছেন বৃদ্ধা ফুলবাসি মন্ডল। সম্প্রতি কয়রা উপজেলার গাববুনিয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, আইলা-পরবর্তী সময়ে সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় জনপদের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে গেছে। অনেকের পেশা বদলে গেছে। মিঠাপানির পুকুরে এখন লোনাপানি। কৃষিজমিতে উৎপাদন কমে গেছে। এখনো বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। এ জন্য প্রতিবছর সামান্য ঝড়েই বাঁধ ভেঙে মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের মানুষের এখন একটাই দাবি—টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা।

কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, আইলার পর ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন শেষ না হতেই বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ে তাঁরা আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। সরকার কয়রা উপজেলার দুটি ইউনিয়নে মজবুত বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। তবে সেই কাজ এখনো শুরু হয়নি। পর্যায়ক্রমে উপজেলার সব ইউনিয়নে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হলে তখন মানুষের আতঙ্ক কমে আসবে।