বীজের কারণে কমেছে ফলন 

ভারত থেকে আমদানি করা সরকারি প্রণোদনার বীজ নিয়ে চাষিরা পেঁয়াজ লাগিয়েছিলেন। এতে আশানুরূপ ফলন পাননি তাঁরা।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বেনীপুর গ্রামের চাষি মাজহারুল ইসলাম খেতের পেঁয়াজ দেখছেন। ফলন ভালো না হওয়ায় হতাশ তিনি। গত সোমবার বেনীপুর মাঠেছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীতে এবার প্রথম পর্যায়ের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে ধস নেমেছে। ভারত থেকে আমদানি করা সরকারি প্রণোদনার বীজ নিয়ে চাষিরা পেঁয়াজ লাগিয়েছিলেন; কিন্তু গতবারের তুলনায় এবার পেঁয়াজের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে; কোনো কোনো চাষির তারও কম উৎপাদন হয়েছে।

কৃষকেরা বলছেন বীজের কারণে তাঁদের এই সর্বনাশ হয়েছে। এই ফলনে তাঁরা হতাশ। তবে বিএডিসি কর্মকর্তারা বলছেন, বীজ নয়, বৃষ্টির কারণে এবার গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আশানুরূপ ফলন হয়নি। মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, এবার গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজের জারমিনেশন (অঙ্কুরোদ্‌গম) ভালো হয়নি। তবে তাদের নিজেদের বীজের ফলন ভালো হয়েছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার প্রথম পর্যায়ে প্রণোদনার বীজ দিয়ে আট হাজার চাষিকে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করানো হয়েছিল। এতে জেলায় মোট ১ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ হয়েছিল। গত রোববার পর্যন্ত পেঁয়াজ তোলা হয়েছে ৪৮৩ হেক্টর জমির। উৎপাদন হয়েছে ৮ হাজার ৬৯৪ টন। গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১৮ টন। গত বছর এই ফলন হয়েছিল হেক্টরপ্রতি ৩০ টন। গতবার পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছিল। দামও ভালো ছিল। চাষিরা রাত জেগে পেঁয়াজের খেত পাহারা দিয়েছিলেন। এবার সেই খেত পড়ে রয়েছে। অনেক চাষি বলছেন, তাঁদের পেঁয়াজ ওঠানোর শ্রমিকের খরচও পেঁয়াজ বিক্রি করে হয়নি।

এমন অবস্থায় পেঁয়াজ চাষের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ হাজার কৃষকের মধ্যে এই প্রণোদনার বীজ বিতরণ করা হয়েছে। এ পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৬৬৬ হেক্টর জমি।

এদিকে প্রণোদনার বীজ পেয়ে রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌর এলাকার চাষি সোহেল রানা হরিয়ান মাঠে পাঁচ বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। সোহেল রানা বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তিনি এই পেঁয়াজের চাষ করেছেন। পাঁচ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করতে তাঁর মোট সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেই পেঁয়াজ আর ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারেননি। বেশির ভাগ পেঁয়াজ মাঠেই নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু পচে নষ্ট হয়েছে আর কিছু ভালো হয়নি।

ওই কৃষক জানান, পাঁচ বিঘা জমিতে সর্বসাকল্যে ১৮ মণ পেঁয়াজ পেয়েছে। এই পেঁয়াজ তোলার শ্রমিকদের খরচই পেঁয়াজ বিক্রি করে মেটাতে পারেননি। রাজশাহীর বড় পেঁয়াজের পাইকারি বাজার খড়খড়িতে এই পেঁয়াজ বিক্রি করতে গিয়ে দেখেছেন, সব চাষির মুখে একই কথা—এবার পেঁয়াজের ফলন হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, এবার পেঁয়াজের বীজ ভালো ছিল না। গতবার তাঁরা ভালো ফলন পেয়েছিলেন। এবার হয়নি।

গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুর গ্রামের কৃষক মাযহারুল ইসলাম জানান, তিনি দেড় বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ করতে বীজ নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি চারাই তৈরি করতে পারেননি। এই বীজ থেকে ঠিকমতো চারা হয়নি। দেড় বিঘা জমির বীজে শেষ পর্যন্ত মাত্র ১০ কাঠা জমিতে পেঁয়াজ লাগাতে পেরেছিলেন। সেই পেঁয়াজ আর বড় হয়নি। এখনো তাঁর মাঠে পেঁয়াজ রয়েছে। গত সোমবার বিকেলে তাঁর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, পেঁয়াজ এখনো জমিতে রয়েছে; কিন্তু সেই পেঁয়াজ একদম ছোট হয়ে আছে।

বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে জানা যায়, বিএডিসি ভারত থেকে আমদানি করা গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজবীজ এনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে দেয়। গতবার তাদের বীজ খুব ভালো ছিল। এবার তাদের বীজের জারমিনেশন (অঙ্কুরোদ্‌গম) খুব খারাপ। সারা দেশে একই অবস্থা হয়েছে।

মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. নূর আলম বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ভারত থেকে ‘এন-৫৩’ পেঁয়াজবীজ আমদানি করা হয়। পেঁয়াজের বীজ অত্যন্ত স্পর্শকাতর উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক বছরের বীজ মজুদ করে পরের বছর করলে আর ভালো ফল পাওয়া যায় না। এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ।

এদিকে বিএডিসির রাজশাহীর উপপরিচালক এ কে এম গোলাম সারওয়ার দাবি করেছেন ভারত থেকে আমদানি করা বীজে কোনো সমস্যা ছিল না। অবিরাম বৃষ্টির কারণে এই সমস্যা হয়েছে। বীজ যেখান দিয়ে আসে, সেখানে বিএডিসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি রয়েছে।