বিভিন্ন জেলায় সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের, যানজটে চরম ভোগান্তি

সিলেটে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা আজ বুধবার দুপুর ১২টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চণ্ডীপুল এলাকায় অবরোধ করেনছবি: প্রথম আলো

ছয় দফা দাবিতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ বুধবার দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। যানজটে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রী ও চালকেরা। এ ছাড়া রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করায় ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে।

রাজশাহী

রাজশাহীর তিনটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ দ্বিতীয় দিনের মতো সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছেন। দুপুর ১২টার দিকে নগরের ভদ্রা মোড় এলাকায় তাঁরা অবস্থান নেন। এতে ওই মোড়ের তিন দিকের সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া রেললাইন অবরোধের কারণে রাজশাহী থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হলে সড়ক ও রেলপথে চলাচল শুরু হয়।

এর আগে আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজশাহী পলিটেকনিক, মহিলা পলিটেকনিক ও সার্ভে ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জমায়েত হন। পরে তাঁরা নগরের রেলগেট এলাকায় আসেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে তাঁরা নগরের ভদ্রা মোড় এলাকায় তিন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড় অবরোধ করেন। এ সময় তাঁরা পাশে থাকা রেলপথেও অবস্থান নেন।

গতকাল মঙ্গলবার রাজশাহী পলিটেকনিক, মহিলা পলিটেকনিক ও সার্ভে ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে নগরের রেলগেট এলাকায় অবস্থান নিয়ে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। পরে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সড়ক ও রেলপথ ছেড়ে দেন তাঁরা।

রাজশাহী পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী ফাহিমুল হক বলেন, ‘ছয় দফা দাবিতে আজ আমরা সারা দেশে কর্মসূচি পালন করেছি। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে আমাদের ভাইদের ওপর হামলা হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসক আজ রাতের মধ্যে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানিয়েছেন ঢাকায় আন্দোলনকারীরা। রাতের মধ্যে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না হলে পুনরায় আগামীকাল কর্মসূচি দেওয়া হবে।’

এদিকে বিকেল পৌনে ৪টা থেকে রাজশাহীতে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে তিনটি ট্রেন আটকে ছিল। সেগুলো রাজশাহী স্টেশনে প্রবেশ করেছে জানিয়ে স্টেশন ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম বলেন, তিনটি ট্রেনের মধ্যে দুইটি ট্রেন প্রবেশ করেছে। সেগুলো দ্রুতই ছেড়ে যাবে। বিকেল বা রাতের অন্য ট্রেনগুলো নির্ধারিত সময়েই ছেড়ে যাবে।

সিলেট

সিলেটে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চণ্ডীপুল এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। এতে ওই মহাসড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। পরে বেলা একটার দিকে তাঁরা সড়ক থেকে সরে যান। পরে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।

এর আগে বেলা ১১টার দিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে মিছিল নিয়ে বের হন। পরে সিলেটের চণ্ডীপুল এলাকায় জড়ো হয়ে সড়ক অবরোধ করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পুলিশের কর্মকর্তারা সড়ক থেকে সরে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তবে বেলা একটার দিকে শিক্ষার্থীরা সড়ক থেকে সরে যান।

ময়মনসিংহ

একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করে আজ বেলা সাড়ে ১১টায় মাসকান্দা এলাকায় ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দীঘারকান্দা বাইপাস এলাকায় গিয়ে দুপুর সোয়া ১২টা থেকে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ।

পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কর্মকর্তারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। বিকেল চারটার দিকে শিক্ষার্থীরা অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।

এর আগে শিক্ষার্থীরা ‘যাদের হাতে স্ক্রু ড্রাইভার, তাদের হাতে চক-ডাস্টার মানায় না’, ‘মামা থেকে মাস্টার, মামা বাড়ির আবদার’, ‘১১৩–এর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘আসো মামা খেলা হবে’, ‘ক্রাফট মামা হঠাও, পলিটেকনিক শিক্ষা বাঁচাও’, ‘তুমি কে, আমি কে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার’, ‘জ্বালোরে জ্বালো, আগুন জ্বালো’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রুমডো ও মোমেনশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দীঘারকান্দা বাইপাস এলাকায় একত্র হয়ে বিক্ষোভ করেন।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এগিয়ে দেন ক্রাফট মামারা। কিন্তু তাঁরা শিক্ষক হতে চান, এটা মানা যায় না। তাঁরা ব্লক পোস্টে যোগদান করে শিক্ষক হলে আমরা যাঁরা কারিগরি শিক্ষা অর্জন করছি, তাঁরা কোথায় যাব? এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে, কারিগরি শিক্ষা ধ্বংস করার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম খান বলেন, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। পুলিশের সতর্ক অবস্থান রয়েছে।

রাজশাহীতে রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ দুপুরে নগরের ভদ্রা মোড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বগুড়া

বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শহরের বনানী এলাকায় ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বসে পড়েন এবং বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এতে মহাসড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, তাঁদের ছয় দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়িত না হলে আন্দোলন আরও তীব্র করা হবে এবং সারা দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে বৃহত্তর কর্মসূচি নেওয়া হবে।

এর আগে একই দাবিতে গতকাল বগুড়া সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা শহরের সাতমাথায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন।

নওগাঁ

আজ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে নওগাঁ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী শহরের ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নওগাঁ-বগুড়া সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় নওগাঁ-বগুড়া রুটসহ শহরের প্রধান সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নওগাঁ-বগুড়া রুটে চলাচল করে দূরপাল্লার কোচ এবং আন্তজেলা রুটে চলাচল করা বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা আটকে পড়ে। এ ঘটনায় শহরজুড়ে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।

নওগাঁ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী মোত্তাকিনুল আলম বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কর্মরত জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদোন্নতি দিয়ে সম্প্রতি হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এই রায় তাঁরা বাতিল চান। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ২০২১ সালে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

আরেক শিক্ষার্থী জাকির রাজিবুল হক বলেন, ‘ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা এর আগে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছি, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে আবারও আন্দোলনে নেমেছি।’

কুমিল্লার কোটবাড়ী এলাকায় ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁদের ছাত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী। আজ দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লা

বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে কোটবাড়ী নন্দনপুর এলাকায় এসে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ১টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত অবরোধ চলে। প্রায় দুই ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধের কারণে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের উভয়মুখী লেনে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্তত আট কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন চালক ও যাত্রীরা। তীব্র গরমের মধ্যে শিশু ও নারীরা বেশি কষ্ট পেয়েছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, বেলা ১১টার দিকে কুমিল্লার কোটবাড়ী এলাকায় অবস্থিত কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁরা দাবি আদায়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মহাসড়কের কোটবাড়ী নন্দনপুর এলাকায় এসে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে বসে পড়েন। অবরোধের কারণে মহাসড়কের উভয় লেনে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এ সময় শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্লোগান দেন। কর্মসূচিতে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। শিক্ষার্থীরা মহাসড়কে বসে পড়লে স্থানীয় প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাঁদেরকে বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক থেকে না সরে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় সেনা সদস্যরা বেশ কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এতে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক থেকে সরে যান এবং হুড়াহুড়ি করতে গিয়ে কয়েকজন আহত হন।

কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ আমরা মহাসড়ক অবরোধ করেছি। দাবিগুলো মানা না হলে সামনে আরও বৃহৎ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি ছোড়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি পরিবহনের বাসচালক জুনায়েদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোটবাড়ী এলাকায় এমনভাবে মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা এর আগেও অনেকবার ঘটেছে। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করছেন। দেড় ঘণ্টার বেশি যানজটে আটকে চরম দুর্ভোগে ছিলাম। আমরা এমন সমস্যার সমাধান চাই।’

কুমিল্লার ময়নামতি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে বেলা ১১টা ৪০ মিনিট থেকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে দুই দিকেই। এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। তবে বেলা ১টা ৩৫ মিনিট থেকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কয়েকটি ফাঁকা গুলি করেছেন। এতে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক থেকে সরে যান।

কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর ট্রাফিক মোড়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ। আজ বেলা বারটার দিকে
ছবি: প্রথম আলো

কুষ্টিয়া

বেলা ১১টা ২৫ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত কুষ্টিয়ার শহরের মজমপুরে ট্রাফিক মোড়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। এরপর তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দিকে চলে যান। কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শতাধিক শিক্ষার্থী পলিটেকনিক থেকে বের হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাঁরা শহর প্রদক্ষিণ শেষে মজমপুরে মহাসড়ক অবরোধ করেন।

দুপুর ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, চতুর্দিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। ট্রাফিক মোড়ে দাঁড়িয়ে মাইকে স্লোগান দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। দু–তিনটি দল মহাসড়কে ফুটবল খেলছে। কেউ কেউ বাসের ছাদে উঠে পতাকা উড়াচ্ছেন। কারও হাতে ব্যানার আবার কারও হাতে প্ল্যাকার্ড। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করেছেন বলে জানান।

অবরোধের সময় পলিটেকনিকের কয়েকজন শিক্ষক ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন এবং মহাসড়ক ছেড়ে দিতে বলে জেলা প্রশাসকের কাছে যাওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সাড়া দেননি। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা রেললাইনের ওপর বাঁশ ও খড়কুটার স্তূপ করেন। সেখানে ট্রেনের একটা ট্রলি যাওয়ার সময় আটকে পড়ে।

কুষ্টিয়া মডেল থানার পুলিশসহ পুলিশ লাইনস থেকেও পুলিশ আসে। তবে তারা মহাসড়কের পাশে ট্রাফিক কার্যালয়ের ভেতর ছিল। সেখানে ওসিসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে তাঁরা মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দিকে চলে যান।

খুলনায় বৈকালী পুরাতন জংশনে চিলহাটিগামী রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে রাখেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

খুলনা

সকাল সোয়া ৯টার দিকে খুলনা রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে আসা খুলনা–চিলাহাটি রুটের রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেন নগরের বয়রা জংশন এলাকায় আটকে দেন শিক্ষার্থীরা। এ কারণে খুলনা স্টেশন থেকে খুলনা-ঢাকা পথের চিত্রা, খুলনা-পার্বতীপুর পথের রকেট, খুলনা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ পথের মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে যায়। পরে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিলে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খুলনার সঙ্গে সারা দেশে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়।

খুলনার স্টেশনমাস্টার জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনা স্টেশন থেকে চিলাহাটিগামী রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে যায়। খুলনা জংশন স্টেশনের আগে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা চলন্ত ট্রেন আটকে দেন। এর ফলে খুলনা স্টেশনে ঢাকাগামী চিত্রা এক্সপ্রেসসহ রকেট, মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেন আটকে পড়ে। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করি। পরে দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিলে সাড়ে ১২টার দিকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। একে একে চিত্রা, রকেট ও মহানন্দা ট্রেন ছেড়ে যায়।

পটুয়াখালী

পটুয়াখালী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা আজ বেলা ১১টার দিকে শহরের বড় চৌরাস্তায় অবস্থান নেন। এতে কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে এর আগে তাঁরা স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন, কিন্তু কোনো সাড়া না পাওয়ায় এবার তাঁরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে বাধ্য হয়েছেন। দাবি আদায় না হলে তাঁরা আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবেন। পরে দুপুর ১২টার দিকে তাঁরা সড়ক থেকে সরে যান।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ

চাঁপাইনবাবগঞ্জে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টার দিকে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু (মহানন্দা সেতু) এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ ঘটনায় সেতুর দুই পাড়ে আটকা পড়ে অনেক যানবাহন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর বেলা একটার দিকে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন শিক্ষার্থীরা।

বরিশাল

বরিশালের বিভিন্ন পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আজ দুপুর ১২টার দিকে নগরের নথুল্লাবাদে জড়ো হন। তাঁরা নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল–সংলগ্ন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে বরিশাল-ঢাকা, বরিশাল-খুলনা, বরিশাল-কুয়াকাটাসহ দূরপাল্লা ও অন্যান্য পথের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অসংখ্য যানবাহন আটকে পড়ায় যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন। এতে শহরজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

কর্মসূচিতে সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ (টিএসসি) কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এ সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নথুল্লাবাদ এলাকায় অবস্থান নেন। বেলা ২টার পর শিক্ষার্থীরা অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। পরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।

দিনাজপুর

দিনাজপুর শহরের ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আজ সকাল সাড়ে ৯টায় রেললাইন অবরোধ করেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁরা দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কে বাঁশ ফেলে অবরোধ শুরু করেন। রেলপথ অবরোধ করায় পঞ্চগড় থেকে ঢাকাগামী তিনটি ট্রেন আটকা পড়ে কয়েক হাজার যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন। পাশাপাশি সড়ক অবরোধ করায় শহরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

এর আগে সকাল ৯টা থেকে ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হতে থাকে দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা ছয় দফাসংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার–ফেস্টুন হাতে সড়কে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় মাইকে শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবি উল্লেখ করে বক্তব্য দেন। বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সড়ক ছেড়ে আন্দোলন করার কথা বললেও শিক্ষার্থীরা সড়ক ছাড়েনি। এ প্রতিবেদন লেখার সময় বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি চলছিল।

রাকিবুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘কিছুদিন থেকেই ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য আমরা আন্দোলন করে আসছি। জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবিগুলোর প্রতি ও আন্দোলনের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তাই বাধ্য হয়ে আমরা আবারও রাস্তায় নেমেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে না, আমরা এভাবেই আন্দোলন করে যাব।’

দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে আমরা কথা বলেছি। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তাঁদের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠকেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কোনো কথা শুনছেন না। আমরা তাঁদের সঙ্গে আলাপ করছি।’

শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি

শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবির মধ্যে ১ নম্বর হচ্ছে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের অবৈধ পদোন্নতির রায় হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল করতে হবে। ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদবি পরিবর্তন, মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুত করতে হবে। ২০২১ সালে রাতের আঁধারে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বাতিল এবং সেই বিতর্কিত নিয়োগবিধি অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে। দ্বিতীয় দাবি, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যেকোনো বয়সে ভর্তির সুযোগ বাতিল করতে হবে। উন্নত বিশ্বের আদলে চার বছর মেয়াদি মানসম্পন্ন কারিকুলাম চালু করতে হবে এবং একাডেমিক কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে ইংরেজি মাধ্যমে করতে হবে। তৃতীয় দাবি, উপসহকারী প্রকৌশলী ও সমমান (১০ম গ্রেড) থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও যেসব সরকারি, রাষ্ট্রীয়, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিম্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের চতুর্থ দাবি, কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় পরিচালক, সহকারী পরিচালক, বোর্ড চেয়ারম্যান, উপসচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব পদে কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত জনবল নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তা আইনানুগভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এই পদগুলোয় অনতিবিলম্বে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ ও সব শূন্য পদে দক্ষ শিক্ষক ও ল্যাব সহকারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। পঞ্চম দাবি, স্বতন্ত্র ‘কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা’ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও ‘কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠন করতে হবে। আর ষষ্ঠ দাবি, পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগের লক্ষ্যে একটি উন্নত মানের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি নির্মাণাধীন চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (নড়াইল, নাটোর, খাগড়াছড়ি ও ঠাকুরগাঁও) পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পাস ও ডুয়েটের আওতাভুক্ত একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আগামী সেশন থেকে শতভাগ সিটে ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল, বগুড়া, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ; প্রতিনিধি, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, কুমিল্লা, দিনাজপুর ও নওগাঁ; সংবাদদাতা, পটুয়াখালী)