গণশুনানিতে উঠে এল গণমানুষের দুর্দশার গল্প
ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ছেলে বিপুল দাসের কাঁধে ভর দিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের গণশুনানিতে হাজির হন মধু রানী দাস (৬৫)। একসময় তাঁর বাড়ি ছিল। ছিল ফসলি জমি। সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নে ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু কীর্তনখোলার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেন। দুই সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন বরিশাল নগরে। সরকারি খাসজমিতে পলিথিনের ঝুপড়ি তুলে বসবাস করছেন তিনি।
মধু রানী দাস গৃহকর্মীর কাজ করে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতেন। ১৫ বছর আগে স্বামী প্রফুল্ল দাস মারা যান। দুই ছেলে এখন পরিণত। তাঁদের দিনমজুরিতে টেনেটুনে চলছে তিনজনের সংসার। আজ বুধবার দুপুরে গণশুনানিতে জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম মধু রানীর কাছে সমস্যা জানতে চাইলে তিনি এসব তথ্য দেন। মধু রানী দাস বলেন, ‘স্যার, মরার আগে নিজের একটা ঘর দেখে মরতে চাই। দুইটা ছেলে যেন নিজের ঘরে মাথা গুঁজে থাকতে পারে, সেইটা দেইখ্যা মরতে চাই।’
বাকেরগঞ্জের দুধল গ্রামের জামাল হাওলাদার (৭০) দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এখন প্রতিবন্ধী। কিডনি জটিলতায় চার বছর আগে ছেলের মৃত্যু হয়। গ্রামে জমিজমা, বাড়ি বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করান। কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বরিশাল শহরে আশ্রয় নেন জামাল। স্ত্রীকে নিয়ে রাস্তার পাশে চা বিক্রি করে সংসার চালান। সরকারি ঘরের জন্য তিনি দুবার আবেদন করেছিলেন, কিন্তু পাননি। গণশুনানিতে এসে বৃদ্ধ জামাল বললেন, ‘একটু আশ্রয় চাই। অনেক জায়গায় ঘরের জন্য ধরনা দিছি, পাই নাই।’
শুধু ঘর নয়; গণশুনানিতে কেউ বাচ্চার দুধ কেনা, পড়াশোনায় সহযোগিতা, চিকিৎসাসহায়তাসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আসেন অসহায় মানুষেরা। মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসকদের গণশুনানি করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয় কয়েক বছর আগে। নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসকদের সপ্তাহের প্রতি বুধবার তাঁর দপ্তরে গণশুনানি করতে হবে। দিনটি জেলা প্রশাসকদের জন্য অন্য কোনো প্রশাসনিক সভাহীন দিবস হতে হবে। বুধবার বিষয়টি যাচাই করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে গণশুনানি হতে দেখা যায়। এতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের দুর্দশার গল্প শোনা যায়।
পটুয়াখালীর মিলি আক্তারের বাবা মারা যান ১২ বছর আগে। মায়ের অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলে দুই বোনের আশ্রয় হয় দাদার কাছে। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মিলিকে দেওয়া হয় পটুয়াখালী শিশু পরিবারে। ৯ বছর সেখানে থেকে এসএসসি পরীক্ষার পর এবার বরিশাল সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছে মিলি। টিউশনির সামান্য আয় দিয়ে মেসভাড়া ও খাওয়ার খরচ মেটানো দায়।
মিলির মতো গণশুনানিতে অংশ নেওয়া ৯ জন শিক্ষার্থীকে পড়াশোনার জন্য এককালীন অর্থসহায়তা দেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্যান্য সমস্যায় আরও ১৩ জন অর্থসহায়তা পেয়েছেন। একজন প্রতিবন্ধীকে একটি হুইলচেয়ার দেওয়া হয়েছে। শুনানিতে মোট ৩৫ জন অংশ নেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক সমাধান পেয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট।
শুনানিতে উপস্থিত জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, গণশুনানিতে তাৎক্ষণিকভাবে যেসব সমস্যা সমাধানযোগ্য, জেলা প্রশাসক সঙ্গে সঙ্গে সমাধান করে দেন। জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য বড় আর্থিক সহায়তার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরে সহায়তার জন্য সুপারিশ করে দেন। সেই অনুযায়ী তাঁরা ব্যবস্থা নেন।
গণশুনানির বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাবিনেট থেকে গণশুনানি করার নির্দেশ আছে। তিনি কয়েক মাস আগে বরিশালে যোগদান করেছেন। যোগদানের পর আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি কাজটি করছেন। যাতে মানুষের সমস্যার কার্যকরী সমাধান হয়। কিছু অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো তদন্তের পর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য একটি নিবন্ধন খাতা মেনটেইন করা হয়।
বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গণশুনানি শব্দটি আলোচিত হলেও চর্চা খুবই কম। গণশুনানি হলো জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষ বা ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, মতামত ইত্যাদি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে শোনা এবং কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথাসম্ভব প্রতিকার করা। কোনো কোনো অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধানও করা হয়। প্রচলিত দাপ্তরিক বা আইনি প্রক্রিয়ায় যার সমাধান হতে অনেক সময় লেগে যেত। বরিশাল জেলা প্রশাসনের এ আয়োজন ইতিবাচক। এটা অব্যাহত থাকুক।