পিবিআই আমাদের কাছে আসে না, বললেন তনুর বাবা, মা চাইলেন বিচার

সোহাগী জাহান তনু

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কিন্তু মামলার তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কোনো আসামিও শনাক্ত হয়নি, অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। পিবিআইয়ের সঙ্গে বাদীপক্ষের দুই বছর ধরে কোনো যোগাযোগও নেই। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ সোমবার সোহাগী জাহান ওরফে তনু হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পূর্ণ হচ্ছে।

তনুর বাবা ইয়ার হোসেন ও মা আনোয়ারা বেগম বলেন, তাঁরা জীবিত থাকাবস্থায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে চান।

থানা-পুলিশ জানায়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী ছিলেন তনু। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে তাঁর লাশ কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরের কালভার্টের ২০ থেকে ৩০ গজ পশ্চিমে ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় ২০১৬ সালের ২১ মার্চ বিকেলে তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।

পরিবারের সদস্যদের কথা বলে জানা যায়, প্রথমে ২০১৬ সালের ২১ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় কোতোয়ালি মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাইফুল ইসলামকে। ২৩ আগস্ট পর্যন্ত আরও দুবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়।

চতুর্থবার ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট আবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করে সিআইডির নোয়াখালী ও ফেনী অঞ্চলের তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) জালাল উদ্দিন আহম্মদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। জালাল উদ্দিন আহম্মদ চার বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত করেও মামলার কিনারা করতে পারেননি।

পঞ্চমবার ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর হত্যা মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) ঢাকার সদর দপ্তরে স্থানান্তর করা হয়। এরপর পিবিআই তিনবার কুমিল্লা সেনানিবাসে এসে মামলার বাদী তনুর বাবা ইয়ার হোসেন, মা আনোয়ারা বেগম ও তাঁদের ছোট ছেলে আনোয়ার হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পিবিআই ২০২০ সালের নভেম্বরের পর বাদীপক্ষের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি দাবি করেছেন ইয়ার হোসেন। এ অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদেই ঘুরপাক খাচ্ছে মামলার তদন্ত।

ইয়ার হোসেন বলেন, মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। এরই মধ্যে পাঁচবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। সিআইডির জালাল উদ্দিন আহম্মদ মামলার তদন্তে কালক্ষেপণ করেছেন। তিনি মামলাটি নষ্ট করে ফেলেছেন। এ বিষয়ে গত শনিবার জালাল উদ্দিন আহম্মদের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন ও খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

ইয়ার হোসেন পিবিআইয়ের তদন্ত প্রসঙ্গে বলেন, পিবিআইয়ের মুজিবুর রহমান নামের একজন কর্মকর্তা তদন্ত করছেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ নেই দুই বছর। মামলা কী অবস্থায় আছে সেটাও জানেন না।

এ বিষয়ে পিবিআই কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, পিবিআই হেড কোয়ার্টারের স্পেশাল টিম এই মামলার তদন্ত করছে। তাই তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না।

বারবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন ও মামলার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ইয়ার হোসেন ক্ষুব্ধ। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘গরিবের কি বিচার আছে আল্লাহ ছাড়া? পিবিআই আমাদের কাছে আসে না। এখনো আসামি চিহ্নিত হয়নি।’

তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মরণের আগে বিচারটা দেখে যেতে চাই। মেয়েকে হারিয়ে আমি সর্বহারা। আমার এই মেয়ের জন্য আমি পড়াশোনায় বিনিয়োগ করেছি। ও পড়াশোনায় ভালো ছিল। পুরো ঘরে এখনো ওর জামাকাপড়, শখের জিনিস ছড়ানো ছিটানো আছে। প্রতিদিনই ওরে মনে পড়ে। ওর জিনিসপত্র দেখি। হাত বুলাই। আর মেয়েটাকে মনে পড়ে। আমি সরকারের কাছে ধনসম্পদ চাই না। বিচার চাই।’

সোহাগী হত্যাকাণ্ডের পর বিচার নিয়ে আন্দোলন করে গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লা ও কুমিল্লার থিয়েটারকর্মীরা। তাঁদের একজন কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মী খায়রুল আনাম। তিনি বলেন,‘এই মামলা হিমাগারে। জাতি চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চায়। মানুষের মনে এই ঘটনার রেশ রয়ে গেছে। ২০ মার্চ কুমিল্লার মানুষের হৃদয়ে আছে।’

এদিকে সোহাগীর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত শুক্রবার কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা পশ্চিম ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে মিলাদ মাহফিল হয়েছে। গ্রামের দুটি মাদ্রাসায় সোহাগীর জন্য দোয়া করা হবে। তবে ২০ মার্চ দিনটি উপলক্ষে কুমিল্লায় আর কোনো কর্মসূচি নেই।