নবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হচ্ছে না ৭ বছর, কারণ ‘মতবিরোধ’

কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য সঙ্গে সংসদ সদস্যের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ মতবিরোধ থেকে সম্মেলন হচ্ছে না সাত বছর ধরে।

হবিগঞ্জ জেলার ম্যাপ

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয় প্রায় ১০ বছর আগে। এর মেয়াদ শেষ হয় ২০১৬ সালে। ওই কমিটির সভাপতিকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সাধারণ সম্পাদক পদত্যাগ করেছেন। কমিটিতে থাকা কয়েকজন নেতা মারা গেছেন। ফলে দলে চলছে নেতৃত্ব-সংকট। 

তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ, বাহুবল) আসনের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ ইউনিয়ন ও উপজেলা কমিটিতে প্রভাব বিস্তার করে তাঁর নিজের লোকজন রাখতে চান। বর্তমান কমিটির নেতারা সেই সুযোগ দেননি। এ নিয়ে কমিটির নেতাদের সঙ্গে সংসদ সদস্যের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ মতবিরোধ থেকে সম্মেলন হচ্ছে না সাত বছর ধরে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের সর্বশেষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ইমদাদুর রহমানকে সভাপতি এবং সাইফুল জাহান চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬৭ সদস্যের কমিটির গঠন করা হয়। ইমদাদুর রহমান ২০১৬ সালে গজনাইপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে হবিগঞ্জ-১ আসনে সংসদ সদস্য হন গাজী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ। তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে উপজেলার বিভিন্ন কমিটিতে পছন্দের লোকজন নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইমদাদুর ও সাইফুল নিজেদের মতো করে বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিটি গঠন করেন। এ নিয়ে শুরু হয় সাংগঠনিক দ্বন্দ্ব।

এরই মধ্যে ২০২০ সালে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ২২৯ সুবিধাভোগীর চাল আত্মসাতের অভিযোগে ইমদাদুরকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর জেরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয় ইমদাদুরকে। ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না পেয়ে ইমদাদুর বিদ্রোহী প্রার্থী হন। যে কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিন আহমদকে।

নেতা-কর্মীরা বলেন, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল জাহান চৌধুরী ২০২২ মার্চ মাসে জেলা আওয়ামী লীগের এক বর্ধিত সভায় সংসদ সদস্য শাহনেওয়াজের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাইফুল দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি-সম্পাদকের কাছে আবেদন করেন। পরে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ দাশকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয় জেলা আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া চলমান কমিটির অর্থ সম্পাদক মোতাহির মিয়া, ধর্ম সম্পাদক কাজী কাজল মিয়া, সদস্য আবদুল মালিকসহ কয়েকজন নেতা মারা গেছেন। 

কমিটিতে পদবি পাওয়ার আশায় থাকা একাধিক নেতা বলেন, গত বছরের ৩১ মার্চ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করে জেলা আওয়ামী লীগ। পরে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে ১৭ মার্চ এ সম্মেলন স্থগিত করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে সেপ্টেম্বর মাসে সম্মেলন করার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। আবার তা স্থগিত করা হয়। দফায় দফায় তারিখ নির্ধারণ করেও সম্মেলন না করায় তাঁরা হতাশ। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সিদ্দিক বলেন, নবীগঞ্জ আওয়ামী লীগের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দিয়ে কোনোরকমে কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। 

দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে কমিটির লোকজনের দ্বন্দ্বের কারণে সম্মেলন হচ্ছে না। সংসদ সদস্য মনে করেন, এখন সম্মেলন করা হলে ইমদাদুর, সাইফুলসহ তাঁদের লোকজন আবার উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চলে আসবেন। যে কারণে তিনি সম্মেলন চান না। এমনকি গত সম্মেলনের তারিখ স্থগিত চেয়ে সংসদ সদস্য লিখিত আবেদন করেছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে। এরপর নতুন করে তারিখ ঘোষণা করা হয়নি সম্মেলনের। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ বলেন, যাঁরা বহিষ্কৃত বা অব্যাহতি পেয়েছেন, তাঁদের নতুন করে দলে ঢোকার আর সুযোগ নেই। কারণ, কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। 

সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হোক, এটা তিনিও চান। সম্মেলন কেন হচ্ছে না, তা কেন্দ্রীয় নেতারা ভালো বলতে পারবেন। সম্মেলন স্থগিত রাখার পেছনে তাঁর কোনো হাত নেই। দলের ভেতরে কোনো অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নেই। কিছু মতবিরোধ থাকতে পারে, তা সব দলেই আছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুল জাহান চৌধুরী বলেন, যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, সঠিক সময়ে প্রায় ৮০ ভাগ ওয়ার্ড কমিটি গঠনের কাজ শেষ করে ফেলেন। নতুন করে আর লোকজনকে জায়গা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। যে কারণে তাঁর সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সংসদ সদস্য তাঁকে নানা ধরনের হুমকি দেন। ভয়ে ও নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি আরও বলেন, গত ৬ মে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তাঁর অব্যাহতি প্রত্যাহারের আবেদন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। তিনি স্বপদে ফিরে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। 

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা তারিখ দিলেই নতুন করে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা
করা হবে।