প্রধান ফটকের পকেট দরজা খোলা। কিছুক্ষণ পরপর সেখান দিয়ে একজন-দুজন করে নারী ও শিশুরা আসছেন। কেউ আসছেন চিকিৎসকের খোঁজে, কেউ ওষুধ নিতে। আবার কেউ আসছেন শুধু পরামর্শ নিতে। কিন্তু হাসপাতাল ভবনে ঢুকে তাঁরা দেখছেন সব কক্ষই তালাবদ্ধ, চিকিৎসক ও ওষুধ কোনোটিই নেই। সেবা না পেয়ে হতাশ হয়ে আবার ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার খড়রিয়ায় অবস্থিত পেড়লি ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে গত সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অবস্থান করে এ চিত্র দেখা যায়। রোগীরা এসে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অফিস সহায়ক রফিকুল ইসলাম জানান, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা কর্মরত আছেন। আর একজন চিকিৎসক (সংযুক্তিতে) আছেন। এই তিনজন সপ্তাহে দুই দিন করে রোগী দেখেন। আজ যে চিকিৎসকের আসার কথা ছিল তিনি ছুটিতে আছেন, ফলে রোগীরা এসে ফিরে যাচ্ছেন।
পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে সেবা নিতে আসা কলেজশিক্ষার্থী মনোয়ারা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি খুলনাতে পড়াশোনা করি। ছুটিতে গ্রামে এসেছি। জরুরি প্রয়োজনে এই হাসপাতালে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম চিকিৎসক নেই, ওষুধ নেই। দুঃখের বিষয় যে কষ্ট করে এসে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে।’
খড়রিয়া এলাকার নাজমা বেগম নামের আরেক সেবাপ্রত্যাশী বলেন, ‘ডাক্তার দেহাতি আইছিলাম, রুম সব তালা মারা। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যি আইসে হাসপাতাল খোলা পাই, আবার মাঝেমধ্যি বন্ধও পাই। ওষুধেরও একই অবস্থা। তবু আসি। কারণ, এ জায়গায় বিনা টাকায় ডাক্তার দেহানো যায়, টুকটাক ওষুধ পাওয়া যায়। এতে আমাগের মতো গরিব মানুষির একটু উপকার হয়।’
মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, কালিয়ার পেড়লি ইউনিয়নের খড়রিয়া বাজারের পাশে ৫০ শতক জমির ওপর নির্মিত এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ২০২০ সালে উদ্বোধন করা হয়। ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে করা হয়েছিল দুটি তিনতলা ভবন। এর মধ্যে একটি হাসপাতাল ভবন। আরেকটি চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টার। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবনে রয়েছে ৫ শয্যা করে ১০ শয্যার ২টি ওয়ার্ড ও ১০টি কেবিন। আছে আধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষ।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এখানে রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য পদ আছে ১০টি। এর মধ্যে দুজন চিকিৎসা কর্মকর্তা, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব), একজন ফার্মাসিস্ট, চারজন পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা, একজন অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক একজন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি চালুর পর থেকে অধিকাংশ পদই শূন্য। একজন ফার্মাসিস্ট ও পরিদর্শিকা নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছেন। কিন্তু উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জনবলসংকট থাকায় তাঁদের সেসব স্থানেও যেতে হয়। ফলে তাঁরা একেকজন এখানে সপ্তাহে দুই দিন করে সময় দেন। সপ্তাহের বাকি দুই দিন সংযুক্তিতে আসা একজন চিকিৎসক এখানে থাকেন। সার্বক্ষণিক থাকেন শুধু একজন অফিস সহায়ক, তিনিও অন্য জায়গা থেকে সংযুক্তিতে এসেছেন।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিদর্শিকা গীতা রানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমি এখানকার নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও আরও তিনটি স্থানে ডিউটি করতে হয়। তাই সপ্তাহে মাত্র দুই দিন এখানে আসতে পারি। এভাবে চালানো সম্ভব নয়। জনবলসংকটে সেবা দেওয়া যায় না। আগে ওষুধ ও পরামর্শ দিতে পারতাম, এখন ওষুধও নেই। তাই রোগীও কমে যাচ্ছে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি সঠিকভাবে চললে পেড়লি, পার্শ্ববর্তী পাঁচগ্রাম ও সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের অন্তত ৪০ হাজার মানুষ সেবা পেতেন। কিন্তু কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো হলেও জনবলসংকটে পাঁচ বছর পরও কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না এ অঞ্চলের মা ও শিশুরা। অবকাঠামো আছে, কিন্তু চিকিৎসক ও ওষুধের সংকটে পড়ে আছে পুরো হাসপাতাল।
হামিদুল ইসলাম নামের এক যুবক বলেন, ‘এলাকার মা ও শিশুদের জন্য সরকার হাসপাতালে করেছে। কিন্তু এখানে ডাক্তার থাকে না, ওষুধ থাকে না। অনেক সময় হাসপাতালের গেট বন্ধ থাকে। আমাদের দাবি, যে সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক।’
জনবল নিয়োগ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক আলিফ নূর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশেই পরিবার পরিকল্পনায় জনবলসংকট রয়েছে। নিয়োগ না হওয়ার কারণ অধিদপ্তর ভালো বলতে পারবে। তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক বড় বাজেটের ব্যাপার রয়েছে। কিছুদিন আগে আমাদের অধিদপ্তর নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল, আমরা সে অনুযায়ী কার্যক্রম এগিয়েছি। আশা করছি, দ্রুতই এ সংকট কাটবে।’
পেড়লি ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য কাসেদ মোল্যা বলেন, ‘এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের সময় আমি কর্তৃপক্ষকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জনগণের করের কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করা হলেও আমার জনগণের তেমন কোনো উপকারে আসছে না। সেবা পাওয়া না গেলে এত টাকা দিয়ে ভবন বানিয়ে লাভ কী?’