যেভাবে জেলায় সেরা হলো টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

গ্রন্থাগারে দল বেঁধে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পেকুয়া, কক্সবাজার। ৩ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

মূল ফটক পার হয়ে সরু হাঁটাপথ। দুই পাশে ফল-ফলাদি ও নানা ঔষধি গাছ। কিছু দূর যেতেই বিদ্যালয়ের মূল ভবন। দেয়ালজুড়ে মনীষীদের বাণী ও বিভিন্ন চিত্রকর্মে ভরা। পরিপাটি, ছিমছাম পরিবেশ। পাশে শিক্ষকদের কক্ষে চোখে পড়ল সততা স্টোর। বই, খাতা, কলম, পেনসিল, রাবারসহ বিভিন্ন সামগ্রী রাখা। শিক্ষার্থীরা মূল্য পরিশোধ করে নিজ দায়িত্বে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে।

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৃশ্য এটি। গত ২০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা শিক্ষা পদক কমিটি টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিদ্যালয়টিতে রয়েছেন ১২ শিক্ষক। তিনটি ভবনে ৯টি শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা করছে ৬৩৮ শিক্ষার্থী।

পেকুয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে টৈটং উচ্চবিদ্যালয় ও টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের ভেতরের দেয়ালে পশুপাখি, ফল ও ফুলকে চিত্রের মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্‌দীন, বেগম রোকেয়া, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শের-ই–বাংলা এ কে ফজলুল হক, নবাব সিরাজদৌলা, শহীদ তিতুমীর, ঈশা খাঁসহ আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবি রয়েছে শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে দেয়ালে।

দেয়ালে আঁকা চিত্রের মাধ্যমে গুণীজনদের সঙ্গে পরিচিত হয় শিক্ষার্থীরা। টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় , পেকুয়া, কক্সবাজার । ৩ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

রয়েছে গ্রন্থাগার, খেলার মাঠসহ সহশিক্ষা কার্যক্রমের নানা সুবিধা। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। গত ১০ বছরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীও অকৃতকার্য হয়নি। বাল্যবিবাহ ঠেকাতে শিক্ষকদের নেতৃত্বে রয়েছে মনিটরিং সেল।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ বলেন, শতভাগ পাস নিয়ে উপজেলায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে বিদ্যালয়টি। প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে কয়েকজন সরকারি বৃত্তি পাচ্ছে। বিনা মূল্যে বিশেষ পাঠদান হয় বিদ্যালয়টিতে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রমে বিদ্যালয়ের ফলাফলও চমৎকার।

বিরতিতে গ্রন্থাগারে পড়ে শিক্ষার্থীরা

শিক্ষকদের কক্ষ পার হলেই গ্রন্থাগার কক্ষ। প্রতিদিন ক্লাস শুরুর আগেই অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে পৌঁছে যায়। তারা গ্রন্থাগার কক্ষে বই নিয়ে বসে পড়ে। দুপুরে শিক্ষার্থীদের ঘণ্টাখানেক বিরতি থাকে। ওই সময়টাও শিক্ষার্থীদের অনেকে গ্রন্থাগারে কাটায়। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাদিয়া সোলতানা জানায়, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গ্রন্থাগারে আরও বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই আছে।

সততা স্টোরে নৈতিক শিক্ষা

ছয় বছর আগে শিক্ষকদের কক্ষের বাইরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সততা স্টোরের। একটি ওয়াল শোকেসে স্টেশনারি সামগ্রী রাখা হয়েছে। এখানে টাকা গ্রহণের কেউ নেই। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী শেফায়েতুজ্জাহান বলে, ‘আমরা ক্যাশবক্সে টাকা রেখে খাতা, কলম, পেনসিল কিনি।’ প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ বলেন, প্রথম প্রথম কিছু শিক্ষার্থী টাকা পরিশোধ না করলেও গত তিন-চার বছরে আর সেটা দেখা যায়নি। তিনি মনে করেন, এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সততা স্টোর থেকে স্টেশনারি পণ্য কিনছে এক শিক্ষার্থী। টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পেকুয়া, কক্সবাজার। ৩ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

‘মহানুভবতার দেয়াল’

বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ভবনের সিঁড়ির গোড়ায় স্থাপন করা হয়েছে ‘মহানুভবতার দেয়াল’। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজের পুরোনো কাপড় এনে ‘মহানুভবতার দেয়ালে’ রেখে যায়। বছরের শুরুতে অনেক শিক্ষার্থী স্কুল ড্রেস সেলাই করতে পারে না। সামর্থ্যবান শিক্ষার্থীরা বছর শেষে পুরোনো স্কুল ড্রেস মহানুভবতার দেয়ালে রেখে যায়। সেখান থেকে যার যেটি দরকার, শিক্ষার্থীরা নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, এর ফলে একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রেরণা দেওয়া হচ্ছে।

বাল্যবিবাহ ঠেকাতে মনিটরিং সেল

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ ২০১৩ সালে যোগদানের পর গঠন করেন ‘মনিটরিং সেল’। গত ১০ বছরে অন্তত ১৩ শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছে এই সেল। সর্বশেষ দুই মাস আগে টৈটংয়ের পাহাড়ি অঞ্চল গুদিকাটার বাসিন্দা পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বিয়ের উদ্যোগ নেন তার মা–বাবা। খবর পেয়ে একজন সহকারী শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষার্থীর বসতঘরে দৌড়ান প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ। পরিবারকে বুঝিয়ে সরিয়ে আনেন বাল্যবিবাহ থেকে। ২০২২ সালে পঞ্চম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীকে ফেরান বিয়ের পিঁড়ি থেকে। ওই শিক্ষার্থী এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে টৈটং উচ্চবিদ্যালয়ে। দুপুরের বিরতিতে কথা হয় ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে। সে বলে, ‘বিয়েতে আমার মতো ছিল না। মা–বাবা জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছেন। হেড স্যার আমাকে রক্ষা করেছেন। আমিও বড় হয়ে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লড়ব।’

খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড

২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্টে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয় টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন খেলাধুলায় প্রায়ই সাফল্যের সাক্ষর রাখে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

নাচ, গান তবলা, হারমোনিয়াম বাজানোসহ নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কনিকা রানী নাথ। বছরে একবার ঘটা করে বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।

কক্সবাজারের পেকুয়ার টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষকদেরও মানতে হয় নিয়ম

তখন ৯টা বাজতে দুই মিনিট বাকি। একজন নারী শিক্ষক দৌড়ে ফটকে ঢুকলেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষক মিলনায়তনে ডিজিটাল ঘড়ি রয়েছে। ৯টার পরে এক সেকেন্ড দেরিতেও যদি বিদ্যালয়ে ঢুকি তাহলে শাস্তি হিসেবে সব সহকর্মীকে নাশতা খাওয়াতে হবে। এ জন্য আমরা কেউ ৯টার পরে বিদ্যালয়ে আসি না।’

ঝরে পড়া রোধে বাড়ি পরিদর্শন

পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় প্রচুর শিক্ষার্থী মাঝপথে ঝরে পড়ত। কেউ লাকড়ি কুড়াত, কেউ চায়ের দোকানে চাকরি নিত। তবে গত ১০ বছরে ঝরে পড়ার হার কমে এসেছে বলে জানান শিক্ষকেরা। কারণ, নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাড়ি পরিদর্শন করেন শিক্ষকেরা। বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাওরিন জান্নাত বলেন, ‘তিন দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে ওই শিক্ষার্থীর বাড়িতে যাই আমরা। অসুস্থতা ছাড়া অন্য বিষয় থাকলে অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করি। ঝরেপড়া রোধ করতে ও অভিভাবকদের সচেতন করতে বিভিন্ন উঠান বৈঠকের আয়োজনও হয়।’

বিদ্যালয়ে আছেন সেরা শিক্ষকেরা

চলতি বছর বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুহাম্মদ ইলিয়াছ নির্বাচিত হয়েছেন উপজেলার সেরা সহকারী শিক্ষক। এর আগে জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া ২০১৯ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মন্ত্রিপরিষদ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের আইসিটি ফর এডুকেশন প্রকল্পের কক্সবাজার জেলার প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস তাঁর হাত ধরেই চলে।

আরও পড়ুন

বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি জাহেদ উল্লাহ বলেন, বিভিন্ন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বিদ্যালয়টিকে শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে। এটা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা থাকবে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, টৈটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পুরো পেকুয়ার গর্ব। ফুটবলে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে পেকুয়াকে সারা দেশে তুলে ধরেছিল বিদ্যালয়টি। পড়াশোনা, মনোরম পরিবেশ, বিভিন্ন ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কারণে জেলার সেরা বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়েছে তারা। ভবিষ্যতেও সেই ধারা অব্যাহত থাকুক এমনটাই আমাদের চাওয়া।