ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উত্তেজনা 

জাহাজের তেল চুরি, বন্য প্রাণী ও এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারসহ মাদকদ্রব্য পাচারের অভিযোগ রয়েছে ঘাট নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। 

খুলনার কয়রা উপজেলার আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ঘাটের সামনের শাকবাড়িয়া নদীতে নোঙর করে আছে জাহাজ। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

খুলনার কয়রা উপজেলার আংটিহারা শুল্ক স্টেশনের ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। যেকোনো উপায়ে ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাঁরা। এর মধ্যে ঘাট থেকে কয়েকজন নৌশ্রমিককে সরিয়ে দিয়ে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।

খুলনা কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয়ের আওতাধীন এ শুল্ক স্টেশনে ভারত থেকে পণ্য নিয়ে আসা লাইটারেজ জাহাজের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। মাঝনদীতে নোঙর করা জাহাজ থেকে লোকজন আনা-নেওয়ার জন্য নৌ মাঝিদের নির্দিষ্ট ঘাট রয়েছে সেখানে।

অনেকেই মনে করছেন ঘাটে কী মধু আছে। এ জন্য তাঁরা আমাকে সরাতে চাইছেন। মূলত তাঁরা চান ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জাহাজের তেল চুরি, বন্য প্রাণী পাচার, মাদক পাচার করে কোটিপতি হতে।
আবু বক্কার, নৌশ্রমিক, আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ঘাট

ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিরা হচ্ছেন স্থানীয় দক্ষিণ বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান আছের আলী মোড়ল, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গাজী শামসুর রহমানের ছেলে মশিউর রহমান ও ঘাটমাঝি আবু বক্কার। দীর্ঘদিন ধরে ওই ঘাট আবু বক্কারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গত কয়েক মাস আগে থেকে তাঁকে সরিয়ে দিয়ে ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আছের আলী। তবে ২৬ মার্চ থেকে আবু বক্কার আবার ঘাটের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন।

নৌশ্রমিক ও জাহাজ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবনসংলগ্ন এ নৌ রুটে প্রতিদিন ২০-২২টি জাহাজ চলাচল করে। ভারত থেকে সিমেন্টের কাঁচামাল ফ্লাইঅ্যাশ, কয়লা, ফার্নেস অয়েল, পাথর, স্টিলের সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে ফেরে এসব জাহাজ। প্রতিটি জাহাজ থেকে শুল্ক স্টেশনে লোকজন পারাপারের জন্য ৩০০ টাকা নেওয়া হয়। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৬ হাজার টাকা হিসাবে মাসে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আয় হয় এ ঘাট থেকে। এ টাকা ইঞ্জিনচালিত নৌকার তেল খরচসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ১০ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত।

সম্প্রতি সরেজমিন আংটিহারা এলাকায় দেখা যায়, শুল্ক স্টেশনসংলগ্ন সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদীতে নোঙর করে আছে ২০টির মতো লাইটারেজ জাহাজ। পাশেই আংটিহারা নৌ পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। শুল্ক স্টেশনের সামনে সড়কের পাশে একটি দোকানে বসে চা-খাওয়ার ফাঁকে দোকানের মালিক তৌহিদুর রহমান জানান, নদীতে নোঙর করা জাহাজ থেকে লোকজন আনা-নেওয়ার জন্য নৌমাঝিদের ঘাট নিয়ে ঝামেলা চলছে। নৌশ্রমিক ইউনিয়ন থেকে এ ঘাট নিয়ন্ত্রণ করা হলেও আবু বক্কার নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি এর নিয়ন্ত্রক। আবার তাঁকে সরিয়ে স্থানীয় দুই প্রভাবশালী পক্ষ এ ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

আংটিহারা শুল্ক স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, কাচের দেয়ালে ঘেরা একটি কক্ষের চেয়ারে বসে আছেন এক ব্যক্তি। অন্য সব কক্ষের দরজা বন্ধ। নিজের পরিচয় দিয়ে বসে থাকা ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি জানান, তাঁর নাম আলমগীর হোসেন, ঘাট মাঝি আবু বক্কার তাঁর মামা। শুল্ক স্টেশনের বিভিন্ন কাজে তিনি মামাকে সহযোগিতা করেন বলে জানান।

ভাগনে আলমগীর কথায় কথায় জানালেন, তাঁর মামা আবু বক্কারের অনেক শত্রু আছে। তারা চায় মামাকে সরিয়ে শুল্ক স্টেশন ও ঘাটের দখল নিতে। মামা যখন স্টেশন ঘাটের দায়িত্ব নেন, তখন কোনো বেতন-ভাতা ছিল না। এ কারণে জাহাজ থেকে ৫-১০ লিটার তেল নিতেন। পরে তেল নেওয়ার বিষয়ে অনেকে আপত্তি করলে জাহাজপ্রতি ২২৫ টাকা করে দিত। আস্তে আস্তে যখন জাহাজের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন মাঝির সংখ্যাও বাড়ে। গত তিন বছর ধরে জাহাজপ্রতি ৩০০ টাকা করে দিচ্ছে মাঝিদের।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে আংটিহারা শুল্ক স্টেশনের পরিদর্শক মো. কোরবান আলী বলেন, ‘এই রুটে প্রতি মাসে ছয় শতাধিক জাহাজ চলাচল করে। এখানে রাজস্ব নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। আমাদের কাজ শুধু জাহাজ আসা-যাওয়ার বিষয়টি রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করা। এখানে যাঁরা নৌশ্রমিকের কাজ করেন, তাঁরা মাঝনদী থেকে জাহাজের নাবিকদের আনা-নেওয়ার কাজ করেন। তাঁরা দাপ্তরিক নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ নয়। এ জন্য তাঁদের কোনো বিষয় আমার জানা নেই।’

আছে তেল চুরি, মাদক পাচারের অভিযোগ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাহাজ থেকে লোক আনা-নেওয়ার বাইরে এ ঘাট থেকে প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে। জাহাজের তেল চুরি সেই আয়ের অন্যতম উৎস। এ ছাড়া বন্য প্রাণী ও এর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারসহ মাদকদ্রব্য পাচারের অভিযোগ রয়েছে ঘাট নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। আর এসব কারণেই ঘাটটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে।

আংটিহারা গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা একসময় ঘাটে মাঝি হিসেবে কাজ করতেন। তিনি অভিযোগ করেন, ঘাটের নিয়ন্ত্রক আবু বক্কারের তেল চুরি ও মাদক পাচারের ঘটনা ফাঁস করে দেওয়ায় তাঁকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার আয়ের মূল উৎস তেল চুরি এবং মাদক চোরাচালান। এসব থেকে প্রতি মাসে ৩০-৪০ লাখ টাকা আয় হয়। এ টাকার ভাগ অনেকেই পেয়ে থাকেন বলে জানান তিনি।

ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাওয়া মশিউর রহমান বলেন, ‘ওই ঘাটের মূল নিয়ন্ত্রক আবু বক্কার একসময় ছিলেন কপর্দকশূন্য। ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে তাঁর আর্থিক উন্নতি হয়েছে ব্যাপক। স্থানীয় প্রভাব খাঁটিয়ে শুল্ক স্টেশনের দাপ্তরিক কাজও তাঁকে করতে দেখা যায়। যে কারণে জাহাজের লোকজনকে এক প্রকার জিম্মি করে তেল চুরি, মাদক পাচারসহ সুন্দরবনের বন্য প্রাণী পাচারের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন বক্কার। এভাবে কয়েক বছরে তিনি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।’

এ কারণে ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করছেন কি না জানতে চাইলে মশিউর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি তা নয়। আবু বক্কার ঘাট থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজনকে সরিয়ে নিজের আত্মীয়স্বজনদের নিয়েছেন। টাকার জোরে এখন কাউকে পাত্তা দিতে চান না। ঘাটের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে তাঁর ঔদ্ধত্য কমে যাবে। আমি মূলত আওয়ামী লীগের লোকজনকে ঘাটে বসাতে চাই।’

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আছের আলী মোড়ল বলেন, ‘ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাই, এটা ঠিক না। আমিও একসময় ওই ঘাটের দায়িত্বে ছিলাম। বিভিন্ন সমস্যা ও রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন খোঁজখবর রাখতাম না। তবে এখন সেখানে আমার লোকজন আছে। আবু বক্কারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় তাকে ঘাটের সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন পুনরায় সে ঘাটে এসেছে বলে শুনেছি।’

জানতে চাইলে ঘাট মাঝি আবু বক্কার বলেন, ‘আমি ঘাটমাঝির পাশাপাশি শুল্ক স্টেশনে “কানামনা” (কাজ নেই, মজুরি নেই) কর্মচারী হিসেবে ২০১২ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছি। নিজের শ্রম ও ব্যবসা করে অর্থ আয় করেছি। এখন অনেকেই মনে করছেন ঘাটে কী “মধু” আছে। এ জন্য তাঁরা আমাকে সরাতে চাইছেন। মূলত তাঁরা চান ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জাহাজের তেল চুরি, বন্য প্রাণী পাচার, মাদক পাচার করে কোটিপতি হতে। কিন্তু ব্যাপারটি অত সহজ নয়।’