অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

ভোলা জেলার মানচিত্র

ভোলার উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার (ডিএফও) কার্যালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই কার্যালয়ের অধীন গাছ বিক্রির একটি দরপত্র সর্বোচ্চ দরদাতাকে না দিয়ে নিম্ন দরদাতাকে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে ঠিকাদারের লাইসেন্স ব্যবহার করে বনজদ্রব্য কেনাবেচার ব্যবসা এবং বেশি দামের গাছ দরপত্রের মাধ্যমে কম দামে বিক্রি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে কমপক্ষে তিনজন ঠিকাদার ঢাকা বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক, উপপ্রধান বন সংরক্ষক, বরিশাল উপকূলীয় বনাঞ্চলের বন সংরক্ষকের কাছে গত জুলাই মাসে ১৫টি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বন অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনা ইউনিটের সহকারী প্রধান বন সংরক্ষক মো. তহিদুল ইসলামের গত ২৭ জুলাই স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বরিশাল উপকূলীয় বনাঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. হারুন অর রশিদ খানকে গত ১০ আগস্টের মধ্যে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন। কিন্তু গতকাল শনিবার পর্যন্ত উপকূলীয় বনাঞ্চলের বন সংরক্ষক ভোলায় তদন্ত করতে আসেননি। জানতে চাইলে উপকূলীয় বনাঞ্চলের বন সংরক্ষক হারুন অর রশিদ মোল্লা বলেন, তদন্তের দায়িত্ব তিনি ভোলার ডিএফও এস এম কায়চারকে দিয়েছেন। তিনি (ডিএফও) ব্যর্থ বা স্বজনপ্রীতি করলে তিনি (বরিশাল বন সংরক্ষক) আবার তদন্ত করবেন।

ঠিকাদারদের ভাষ্য, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাঁদেরই যদি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়, সে তদন্ত কখনো সঠিক হবে না। তাঁরা নিরপেক্ষ তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।

বন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বরাবর গত জুন-জুলাই মাসের একাধিক তারিখে মেসার্স মনির অ্যান্ড ব্রাদার্স টিম্বারের মালিক মো. মনির হোসাইন ১৩টি অভিযোগপত্র দাখিল ও গণশুনানিতে অংশ নিয়েছেন। বাকি দুটি অভিযোগ করেছেন মেসার্স সিকদার কনস্ট্রাকশনের মো. তানভীর হোসেন (বুলবুল) ও মেসার্স নাহার এন্টারপ্রাইজের মো. মিজানুর রহমান।

বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষকের কাছে ২৪ জুলাই জমা দেওয়া অভিযোগে ঠিকাদার মো. মনির হোসাইন লিখেছেন, ভোলা উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রদীপ কুমার রায়ের (কম্পিউটার অপারেটর) নেতৃত্বে একটি চক্র ১০ বছর ধরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এই চক্রের সঙ্গে ওই কার্যালয়ের মো. নজরুল ইসলাম (প্রধান সহকারী), মো. আমিনুল ইসলাম (বনপ্রহরী কাম কম্পিউটার অপারেটর) ও মো. শাজাহান (পিয়ন) আছেন। শাজাহানের মাধ্যমে সব টাকার লেনদেন হয়। এ চক্রটিকে সহায়তা করেন কার্যালয়ের ডিএফও ও সহকারী বন সংরক্ষক। সুবিধা পাওয়ায় চক্রটি যা বলে, কর্মকর্তারা তা–ই মেনে নেন। তবে বনজদ্রব্য বিক্রি এবং দরপত্রে অনিয়ম করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ডিএফও এস এম কায়চার।

ঠিকাদার মনির হোসাইন এই বন বিভাগের বিভিন্ন কার্যালয়ে ১২টি অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, চলতি বছরের ২ মে ভোলার স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। ডিএফও এস এম কায়চার তাতে ৮৪টি লটের বনজদ্রব্য বিক্রির দরপত্র আহ্বান করেন। ওই গাছ ভোলা সদর, বোরহানউদ্দিন, দৌলতখান ও চরফ্যাশন উপজেলার বিভিন্ন রেঞ্জের আওতাভূক্ত। ১৪ মে ভোলার বিভিন্ন রেঞ্জের বিক্রয়কেন্দ্রে ৮৪টি লটের মধ্যে মাত্র ৩৯টি লটের দরপত্র বিক্রি শুরু হয়। বাকি ৪৫টি লটের দরপত্র কোথায় জানতে চাইলে বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ঠিকাদারদের বলা হয়, ডিএফও কার্যালয়ের টেন্ডার শাখা থেকে বাকি দরপত্র দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে ডিএফও কার্যালয়ের টেন্ডার শাখার দায়িত্বে থাকা কম্পিউটার অপারেটর প্রদীপ কুমার রায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম ভাঙিয়ে বলেন, তাঁরা চরফ্যাশন উপজেলার ১৩টি লট ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার ২২টি লটসহ ৪৫টি লটের দরপত্র বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। একই কথা বলেন ডিএফও এস এম কায়চার ও সহকারী বন সংরক্ষক মো. মনিরুজ্জামান।

মনির হোসাইন অভিযোগ করেন, গত ১৮ মে ৫৮টি লটের দরপত্র দাখিল করলে তিনি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে ১৩টি লট পান। কিন্তু তাঁকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। তিনি ১২ জুন বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারেন, ডিএফওকে চরফ্যাশন ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার ৩২টি লটের দরপত্র বিক্রি করতে বাধ্য করায় চক্রটি সর্বোচ্চ দরদাতার দরপত্রের ফাইল থেকে কাগজপত্র সরিয়ে দরপত্র বাতিল করার পরিকল্পনা করছে। ১৩ জুন চক্রটি সরাসরি ঠিকাদারের (মনির) কাছে মোটা টাকা ঘুষ দাবি করে। চক্রের দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় দরপত্রের সঙ্গে ভ্যাটের রসিদ নেই বলে দরপত্র বাতিল করে দেয়।

লিখিত অভিযোগপত্রে মনির হোসাইন বলেন, ১৩টি লটের দরপত্রে তিনি সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ৩২ হাজার ৬৮১ টাকায় মূল্য দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দরদাতা হিসাবে যাঁদের লটগুলো দেওয়া হয়েছে, তাঁরা মূল্য হিসাবে ১৭ লাখ ৩৪৬ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। এ কারণে সরকার ১ লাখ ২৯ হাজার ২১৭ টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য ভোলা ডিএফও কার্যালয়ের সহকারী বন সংরক্ষক মো. মনিরুজ্জামান, কম্পিউটার অপারেটর প্রদীপ কুমার রায়কে ফোন দিলে তাঁরা ফোন ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালে মনিরুজ্জামান লেখেন, তাঁর ও তাঁর কার্যালয়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন।

এ বিষয়ে ডিএফও এস এম কায়চার তাঁর ও তাঁর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে করা অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, ভ্যাটসংক্রান্ত কাগজপত্র না থাকায় ওই ১৩টি লট সর্বোচ্চ দরদাতাকে দেওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে অভিযোগকারী ঠিকাদারের সঙ্গে তাঁর সমঝোতা হয়েছে।