পাহাড়ের প্রথম চিত্রশিল্পী চুনীলাল দেওয়ান, ছিলেন জয়নুল আবেদিনের ঘনিষ্ঠ

চুনীলাল দেওয়ান

পার্বত্য চট্টগ্রামে শিল্পচর্চার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে যে কয়জনের নাম প্রথমে আসবে, তাঁদের মধ্যে চুনীলাল দেওয়ান একজন। একাধারে চিত্রশিল্পী, কবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও ভাস্কর্যশিল্পী ছিলেন। বাজাতে পারতেন হারমোনিয়াম, পিয়ানো, বাঁশি, সেতার ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী চুনীলাল ছিলেন পাহাড়ের প্রথম আধুনিক চিত্রশিল্পী।

রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলায় চেঙ্গী বরাদাম গ্রামে (বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদে তলিয়ে যাওয়া গ্রাম) তাঁর পৈতৃক নিবাস। তবে ১৯১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বাবার কর্মস্থল খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার একটি বাড়িতে জন্ম তাঁর। বাবা শশীমোহন দেওয়ান দীঘিনালা থানার দারোগা ছিলেন। সেই সূত্রে শৈশব কাটে দীঘিনালায়।

রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে সাধারণ শিক্ষা শেষ করে চুনীলাল কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বেশ সাফল্যের পরিচয় দেন। সহজাত প্রতিভার কারণে রবীন্দ্রনাথেরও নজর কেড়েছিলেন তিনি। ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বন্ধু।

চুনীলাল দেওয়ানকে নিয়ে বিভিন্ন লেখা পড়ে এবং তাঁর স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ব্যক্তিজীবনে দুটি বিয়ে করেন চুনীলাল। প্রথমে বিয়ে করেন কউলি বাজারের চৌধুরী আনন্দ মোহন দেওয়ানের মেয়ে চারুবালা দেওয়ানকে। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি বিয়ে করেন বসুন্ধরা দেওয়ানকে।

চুনীলাল দেওয়ান ছিলেন মূলত চিত্রশিল্পী। পেনসিল বা কলমের স্কেচ, জলরং ও তেলচিত্র এঁকেছেন তিনি। তাঁর চিত্রকর্মের উপজীব্য ছিল বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি, পাহাড়ি সমাজের মানুষ এবং তাঁদের সহজ–সরল জীবনধারা। ঢাকায় অনুষ্ঠিত লোকশিল্প প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম ব্যাপকভাবে দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান তাঁর চিত্রকর্মের বেশ প্রশংসা করেন। জয়নুল আবেদিন ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে ‘জলপ্রপাত’ নামে বিখ্যাত ছবিটি আঁকেন। ঢাকা, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে তাঁর অঙ্কিত চিত্রকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

চুনীলালের অধিকাংশ চিত্রকর্মই নানাভাবে হারিয়ে গেছে। অল্প কয়েকটি ছবি আজও তাঁর স্মৃতি ধরে রেখেছে। মাটি, সিমেন্ট, কাঠ ইত্যাদি উপাদানের মাধ্যমে তিনি ভাস্কর্য গড়তেন। তাঁর নিজের আবক্ষ মূর্তি, কাঠের ওপর খোদাই করা বুদ্ধ ও আনন্দের ভাস্কর্য বর্তমানে নানিয়ারচরের বিশ্বলতা জনকল্যাণ বৌদ্ধবিহারে এবং রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাদুঘরে রক্ষিত আছে।

চুনীলাল দেওয়ানের নাতি স্কুলশিক্ষক অর্পণ দেওয়ান বলেন, তাঁর বাবা যখন ছোট ছিলেন তখন তাঁর দাদা মারা যান। দাদার সঙ্গে তাঁদের কোনো স্মৃতি নেই। তাঁর দাদার যেসব শিল্পকর্ম ছিল সেগুলো তাঁরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইনস্টিটিউটের জাদুঘরে দিয়ে দিয়েছেন।

রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তা শুভ্র জ্যোতি চাকমার বেশ কিছু লেখা রয়েছে চুনীলাল দেওয়ানকে নিয়ে। তিনি বলেন, চুনীলাল দেওয়ান চাকমা ভাষায় প্রথম আধুনিক কবিতাও রচনা করেন। তাঁর ছেলে দেবীপ্রসাদ দেওয়ানের প্রচেষ্টায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা কবির কবিতাগুলোর পাণ্ডুলিপি সংগৃহীত হয়েছে। তাতে বাংলা ভাষায় রচিত ১১টি কবিতা রয়েছে। এ ছাড়া চুনীলাল দেওয়ানের নিজ হাতে তৈরি পাণ্ডুলিপিতে ৩২টি গান পাওয়া গেছে। ১৯৭৯ সালে রাঙামাটি প্রকল্পনা সাহিত্যাঙ্গন থেকে প্রকাশিত কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর বেশ কয়েকটি গান প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৮০ সালে একই প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর গীত সংকলন ‘নিবেদন’। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যই তাঁকে গীতি কবিতা রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল বলে জানা যায়।

চুনীলাল দেওয়ানের একটি চিত্রকর্ম
সংগৃহীত

শুভ্র জ্যোতি চাকমা আরও বলেন, ‘চুনীলাল দেওয়ানকে নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ–নিবন্ধ লেখা হয়েছে। তাঁর পাণ্ডুলিপি নিয়ে একটা বই আছে আমাদের সংগ্রহে। এ ছাড়া তাঁর আঁকা ১০ থেকে ১৩টি চিত্রকর্ম আমাদের ইনস্টিটিউটে সংরক্ষিত আছে।’

বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া কবি ও গবেষক মৃত্তিকা চাকমার সঙ্গে কথা হয় এ প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, চুনীলাল দেওয়ান পাহাড়ের প্রথম চিত্রশিল্পী। তিনি শুধু চিত্রশিল্পী ছিলেন না, চাকমা সমাজ তথা পাহাড়ের একজন আলোকিত মানুষও ছিলেন। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের তাঁর সম্পর্কে ধারণা নেই। বড় পরিসরে তাঁকে স্মরণ করা উচিত।

১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এক আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চুনীলাল দেওয়ান। কিন্তু তাঁর আর যাওয়া হয়নি। সে বছরের ৮ ডিসেম্বর খাদ্যে বিষক্রিয়ার (ফুড পয়জনিং) শিকার হয়ে তিনি মারা যান।