পাখিদের মধ্যেও স্থপতি আছে, কে সে জানেন
‘পাকা হোক তবু ভাই পরের ও বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।’ রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতার এই লাইন আমাকে বাবুই পাখির কথা মনে করিয়ে দেয়। আমাদের গ্রামে এমন অনেক তালগাছ ছিল, যেখানে বাবুই পাখির বাসা ঝুলতে দেখতাম। নিপুণ বুননে গড়ে তোলা বাসাগুলো যেন একেকটা ইমারত।
প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে বাবুই পাখি এখনো সারা দিন খেটে মনের সুখে তৈরি করে যায় নিজের বাসা। সাধারণত পুরুষ তালগাছে বাসা বাঁধে বাবুই পাখি। কখনো কখনো নারকেল বা খেজুরগাছেও দেখা যায় এদের বাসা। বাসা বানানোর জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে। দল বেঁধে বা একা উড়ে গিয়ে ধান কিংবা ঘাসের মাঠে নামে তারা। সেখান থেকে ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ সরায়। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে (পালিশ করে) গোল অবয়ব মসৃণ করে। সেই আঁশ নিয়ে গিয়ে গাছের পাতায় পেঁচিয়ে সুনিপুণভাবে তৈরি করে বাসা।
বাবুই পাখির বাসার স্থাপত্যশৈলী দেখে বলতেই হয়, মানবসভ্যতার পাশাপাশি স্থাপত্যকর্মের নজির আছে প্রকৃতিতেও। বাবুইয়ের বাসা অনেকটা ওলটানো কলসির মতো দেখতে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিক বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা করা হয়। অন্য দিকটি লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থানপথ হয়। যদিও তালগাছ কমে যাওয়ার কারণে এই দৃশ্য এখন অনেকটা বিরল আমাদের দেশে। তবে গ্রামে-গঞ্জে যেখানে তালগাছ আছে, সেখানে এ দৃশ্য নজর কাড়ে সবার।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্সা এলাকায় একসঙ্গে বেশ কয়েকটি তালগাছ আছে। সেখানে প্রতিবছর এমন সময়ে বাসা তৈরি শুরু করে বাবুই পাখিরা। ওই জায়গায় গেলেই সড়কের পাশে থাকা তালগাছের নিচে কিচিরমিচির শব্দ আসে কানে। পাখির কলতানের উৎস ধরে তাকালে চোখ চলে যায় তালগাছের মগডালের দিকে। তখন চোখে পড়ে স্থপতি বাবুইয়ের বাসা তৈরির অনন্য দৃশ্য। প্রতিটি তালগাছে ৮০-১০০টা বাবুই পাখি দেখা যায়। ভোর থেকেই ঘাসের আস্তরণ খুঁজে বাসা তৈরি করতে লেগে যায় পাখিগুলো।
ওই এলাকার একটি তালগাছে চোখ পড়ে এদের। ছবি তোলার সময় খেয়াল করি তালগাছ থেকে একটু দূরে খোলা মাঠ। যেখানে গরুর জন্য লাগানো হয়েছে ঘাস। সেই মাঠে উড়ে গিয়ে বসছে পাখিগুলো। একটু কৌতূহলী হলাম। ক্যামেরার লেন্স দিয়ে জুম করে দেখি সেখান থেকে শুকনো ঘাস নিচ্ছে তারা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কয়েকটি ঘাস নিয়ে আবার ফিরে আসছে গাছে। তারপর সেটি দিয়ে ঠোঁটে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি করছে বাসা।
বাবুই Ploceidae গোত্রের অন্তর্গত এক দল প্যাসারাইন পাখি। খুব সুন্দর বাসা বোনে বলে এরা ‘তাঁতি পাখি’ (Weaver Bird) নামেও পরিচিত। এরা মূলত বীজভোজী পাখি, সে জন্য তাদের ঠোঁটের আকৃতি বীজ ভক্ষণের উপযোগী; চোঙাকার আর গোড়ায় মোটা। অধিকাংশ বাবুই প্রজাতির আবাস সাব-সাহারান আফ্রিকায়, তবে কয়েকটি প্রজাতি এশিয়ায় স্থায়ী। আমাদের দেশে তিন ধরনের বাবুই দেখা যায়। দেশি বাবুই, দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই।