দেশে বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। এরপরই অবস্থান বরিশাল বিভাগের। গত ৪ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের প্রকাশ করা ‘ব্রিদিং হেভি: বায়ুদূষণের নতুন তথ্যপ্রমাণ এবং স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেখানের মানুষ বিষণ্নতায়ও বেশি ভোগেন। দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ বাসিন্দা বিষণ্নতার শিকার। এসব এলাকায় বাড়ছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও। এই প্রতিবেদনের বাস্তবতা মেলে বরিশাল বিভাগে এবার শীত মৌসুমে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যাওয়ার ঘটনায়। বিভাগে গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় চার হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বায়ুদূষণ রোধে করণীয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ এইচ এম রাশেদ।
প্রথম আলো: বরিশালে সাম্প্রতিক দূষণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণ কী বলে মনে করছেন?
এ এইচ এম রাশেদ: বরিশাল বিভাগটি নদীমাতৃক হওয়ায় এখানে শিল্পায়ন হয়নি। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর শিল্পায়নের দিকে যাচ্ছে। তবে সেতু চালুর পর নতুন নতুন নানা স্থাপনা, রাস্তাঘাট নির্মাণ বেড়ে গেছে। বেড়েছে কয়েক গুণ যানবাহন চলাচল। দ্রুত নগরায়ণ হওয়ায় পাকা ইমারত হচ্ছে শহর-গ্রাম সব স্থানে। ফলে বায়ুদূষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
প্রথম আলো: আগে দূষণের মাত্রা কেমন ছিল, এখন বাড়ল কেন?
এ এইচ এম রাশেদ: আমরা মূলত প্রতি মাসে বরিশাল নগরের দুটি বাসস্ট্যান্ড এবং কিছু অপেক্ষাকৃত নীরব এলাকায় বায়ুমান পরীক্ষা করি। সাসপেন্ডেড পার্টিকুলার ম্যাটারে (এসপিএম) এ পরীক্ষা করা হয়। ধোঁয়া, ধুলা, বাষ্প ও একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে বাতাসে ভেসে থাকা কঠিন পদার্থের কণাকে এসপিএম বলে। এতে বরিশালের বেশির ভাগ এলাকায় এসপিএম মাত্রা ১৫০ থেকে ২০০। এটা মোটামুটি সহনীয় মাত্রা। তবে নগরের নথুল্লাবাদ ও রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে এই মানের কয়েক গুণ বেশি, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। আগে বায়ুদূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও ইদানীং তা ভয়াবহভাবে বাড়ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ। গ্রামগুলোর যেমন দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, তেমনি উন্নত জীবনের আশায় দিন দিন মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। নগরায়ণ ও শহরের মানুষের চাপ বাড়ায় এর বহুমুখী প্রভাব পড়ে পরিবেশ-প্রকৃতিতে। এসব মানুষের জন্য আবাস নির্মাণ হচ্ছে, পরিবহন বাড়ছে, দৈনন্দিন বর্জ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে আছে ইটভাটার দূষণ।
প্রথম আলো: বায়ুদূষণ রোধে কী ধরনের উদ্যোগ আছে আপনাদের?
এ এইচ এম রাশেদ: যেসব প্রতিষ্ঠান কিংবা যানবাহন বায়ুদূষণের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে মামলা করা হচ্ছে। তবে দূষণ রোধে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তবিভাগীয় সমন্বয় জরুরি।
প্রথম আলো: পরিস্থিতি কি দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে?
এ এইচ এম রাশেদ: পরিস্থিতি তো ভয়াবহ হচ্ছে। এটি রোধে সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন ও শহরায়ণ হতে হবে পরিকল্পিত। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। বিআরটিএকে এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর সব সময় দায়বদ্ধ। দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা চলমান থাকবে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত অন্য সবাইকেও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, পরিবেশ দূষিত করেন গুটিকয় ব্যক্তি, এর ভুক্তভোগী হয় গোটা জনগোষ্ঠী। এই বোধ জাগ্রত করা খুব জরুরি।
প্রথম আলো: দূষণ রোধে কাজ করতে বাধাগুলো কী?
এ এইচ এম রাশেদ: দূষণ রোধে কাজ করতে সবচেয়ে বড় বাধা মানুষের অসচেতনতা। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের মূল বাধা হচ্ছে জনবলসংকট এবং বাজেট-স্বল্পতা। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অধিদপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া জনগণের সচেতনতার অভাব, কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবেও স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
প্রথম আলো: বিভিন্ন স্থানে অবৈধ এবং অপরিকল্পিত ইটভাটা, ব্যাটারি তৈরির কারখানা হচ্ছে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগ কি যথাযথ মনে করেন?
এ এইচ এম রাশেদ: অবৈধ ইটভাটা, ব্যাটারি তৈরির কারখানা অবশ্যই পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী। এদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা করে তৎক্ষণাৎ জরিমানা আদায় করছে। দ্রুততার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম আলো: সবার অংশগ্রহণে পরিবেশদূষণের হাত থেকে বাঁচাতে কোনো সমন্বিত কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক প্রভাবে বিভিন্ন স্থানে ইটভাটাসহ বিভিন্ন কারখানা তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
এ এইচ এম রাশেদ: দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনে পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিবেশ সুরক্ষা আমাদের সবার জন্য দরকার, তাই সবার সহযোগিতা ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সব দপ্তরের সহযোগিতা এবং সমন্বিত কাজের মাধ্যমেই পরিবেশ রক্ষায় আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর সব সময় পরিবেশ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে কোনো স্থাপনা গড়ে উঠলেও সেটা পরিবেশ আইন ও বিধিমালার বাইরে পরিচালনের কোনো সুযোগ নেই। তবে পরিবেশ সুরক্ষায় রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে এটা সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।