পদ্মায় বিলীন তিন গ্রাম, গৃহহীন ৭০০ পরিবারের অনিশ্চিত জীবন
পদ্মা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বিলীন হয়ে যাওয়া বসতবাড়ির শেষ চিহ্ন খুঁজছিলেন মোসলেম শেখ (৬৫)। এক মাস আগে ২০ শতাংশ জমিসহ তাঁর বসতবাড়িটি পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এখন সেটি শুধু স্মৃতি। হারিয়ে যাওয়া সেই স্মৃতি খুঁজতে তিনি প্রায়ই নদীর তীরে এসে দাঁড়ান, আর চোখের পানি ফেলেন।
জাজিরার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের আহম্মদ মাঝিকান্দি গ্রামে ছিল মোসলেম শেখের বাড়ি। শুধু তিনি নন, একই অবস্থা ওই ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের সাড়ে চার হাজার মানুষের। গত দুই বছরের ভাঙনে গ্রাম তিনটি এখন পদ্মার পানির নিচে। গৃহহীন হয়েছে ৭০০ পরিবার। দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সামাজিক অবকাঠামোগুলোও পদ্মায় বিলীন হয়েছে।
মোসলেম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, কৃষিকাজ করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। পদ্মা নদীতে তাদের গ্রামসহ তিনটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। বাপ-দাদার ভিটা হারিয়েছে। নদীর অপর পারে একটি জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। ৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন বিপাকে আছেন তিনি। জীবনটাই অনিশ্চিত হয়ে গেছে তাঁর।
স্থানীয় সূত্র ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নটি পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। ওই ইউনিয়নের ওপর দিয়েই পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। সেতু-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবকাঠামোও রয়েছে সেখানে। ২০০৩ সালে পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নে প্রথম বড় ভাঙন হয়। তখন পাইনপাড়া মৌজাটি পদ্মায় বিলীন হয়। পাঁচ বছর পর, ২০০৮ সালে পাইনপাড়া এলাকায় নতুন চর জেগে ওঠে। এর মাঝ দিয়েই তৈরি হয় পদ্মার নতুন একটি প্রবাহ। ২০১০ সালে ওই চরে মানুষ আবার বসতি গড়ে তোলে—আহম্মদ মাঝিকান্দি, মনসুর মোল্যাকান্দি ও আলীম উদ্দিন ব্যাপারীকান্দি নামে তিনটি গ্রাম গড়ে ওঠে। পরে গ্রাম তিনটির পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে নির্মিত হয় পদ্মা সেতু।
২০১০ সাল থেকে পাইনপাড়া মৌজার ওই তিনটি গ্রামে ৭০০ পরিবার বসবাস করছিল। সাড়ে চার হাজার বিঘা জমিতে তারা ধান, পাট, ধনিয়া, সরিষাসহ নানা ফসল ফলাতেন। শিশুদের পড়াশোনার জন্য ছিল দুটি বিদ্যালয়—পাইনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২০১৬ সালে স্থাপিত রিজিয়া আমিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আহম্মদ মাঝিকান্দি গ্রামে ছিল বিদ্যালয় দুটি। এ ছাড়া স্থানীয় লোকজনের চিকিৎসাসেবার জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিকও স্থাপন করা হয়েছিল।
গত বছর পদ্মার ভাঙনে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে যেতে শুরু করে। গত বছরের আগস্টে পাইনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বিলীন হয়ে যায়। এ বছর জুলাই মাসে আবারও ভাঙন দেখা দেয় ওই এলাকায়। ২৮ আগস্ট রিজিয়া আমিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিউনিটি ক্লিনিকটিও পদ্মায় বিলীন হয়। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভাঙনে বসতবাড়ি, মঙ্গলমাঝি হাটের ২০টি দোকান ও সাড়ে চার হাজার বিঘা ফসলি জমি পদ্মায় হারিয়ে গেছে। এখন ওই চরে কোনো বসতবাড়ি নেই। কিছু জায়গা এখনো টিকে থাকলেও সেখানে কেউ বসবাস করছেন না। ক্ষতিগ্রস্ত ৭০০ পরিবারের অনেকে নাওডোবা ইউনিয়নের দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) অধিগ্রহণ করা জমিতে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছেন।
বিবিএর মাঠে স্থাপন করা হয়েছে পাইনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রিজিয়া আমিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয়েছে নাওডোবা মাঝিকান্দি এলাকার রাজ্জাক মাঝির বাড়ির একটি বসতঘরে। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইমরান আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোখের সামনে বিদ্যালয়টি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এখন নদীর দক্ষিণ পারে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালাচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। ওই চরের ৭০০ পরিবার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে।’
গৃহহীন ৭০০ পরিবারের মধ্যে অন্তত ৩০০ পরিবার বিবিএর জমিতে ছাপরা তুলে বসবাস করছে। তবে ওই জমি ছাড়ার নোটিশ পেয়েছে তারা। পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় গভীর অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে তারা। আশ্রয়হীনদের একজন হাসেম মৃধা (৬৭)। ভাঙনে তাঁর সাত বিঘা ফসলি জমি ও তিন বিঘা জমির ওপর থাকা বাড়ি নদীতে হারিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মাঝারি কৃষক পরিবার ছিলাম, সংসারে কোনো অভাব ছিল না। এখন নিঃস্ব। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সরকারি জমিতে থাকছি।’
পদ্মা সেতুর ৩৬ থেকে ৪৪ নম্বর পিয়ারের ভাটিতে ছিল পাইনপাড়ার ওই তিনটি গ্রাম। গত দুই বছর ধরে ভাঙনের কবলে পড়ে এলাকা। ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় লোকজন একাধিক মানববন্ধন করেছেন, কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গৃহহীন মানুষদের পুনর্বাসনেও কোনো উদ্যোগ নেই।
জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাবেরী রায় প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর নাওডোবা এলাকায় পদ্মার দুই তীরেই ভাঙন ছিল। দক্ষিণ তীরে পদ্মা সেতুর নানা অবকাঠামো থাকায় সেখানে ভাঙন ঠেকানো অগ্রাধিকার পেয়েছে। তাই চরের দিকে নজর দিতে পারিনি। ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য খাস জমি খোঁজা হচ্ছে।