অধ্যাপকের বিরুদ্ধে গবেষণা চুরির অভিযোগ, তদন্ত কমিটি নিয়ে ধোঁয়াশা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ তারেক চৌধুরীর বিরুদ্ধে গবেষণা জালিয়াতি ও অশোভন আচরণের অভিযোগ করেছিলেন একই বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ। অভিযোগের সপক্ষে প্রশাসনের কাছে তথ্যপ্রমাণও সরবরাহ করেছেন তিনি। অভিযোগ তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

অভিযুক্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ তারেক চৌধুরী গবেষণা জালিয়াতির অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি উল্টো অধ্যাপক ফরিদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন।

এদিকে সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত একাধিক শিক্ষক তদন্ত কমিটি গঠনের ব্যাপারে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হাসান তা অস্বীকার করেছেন।

অধ্যাপক তারেক চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত বছরের মার্চে উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৮ এপ্রিল প্রশাসন তাঁর কাছে তথ্যপ্রমাণ চাইলে ২৩ জুলাই তথ্যপ্রমাণ সরবরাহ করেন তিনি। এরপর চলতি বছরের ১ এপ্রিল সিন্ডিকেট সভায় চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

লিখিত অভিযোগে অধ্যাপক ফরিদ উল্লেখ করেন, ২০১১ সালে দর্শন বিভাগের একাডেমিক জার্নাল কপুলায় (Copula) ‘ঈশ্বরের স্বরূপ প্রসঙ্গে ধর্মীয় ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি: একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন অধ্যাপক তারেক চৌধুরী। প্রবন্ধে তিনি অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস ‘থেলিস থেকে হিউম’ গ্রন্থ থেকে ১ হাজার ৩৪৩ শব্দ চুরি করেছেন, যা মূল প্রবন্ধের প্রায় ১৯ শতাংশ। ওই প্রবন্ধ ব্যবহার করে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন তারেক চৌধুরী। নিয়মানুযায়ী কোনো গ্রন্থ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়া যায়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, অধ্যাপক তারেক ওই প্রবন্ধে অধ্যাপক অর্জুন বিকাশ চৌধুরীর ভারতীয় দর্শন গ্রন্থ থেকে ৭২ শব্দ, প্রমোদ বন্ধু সেনগুপ্তের ‘পাশ্চাত্য দর্শনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আধুনিক যুগ’ গ্রন্থ থেকে ৩৭৯ শব্দসহ প্রায় ২ হাজার ২ শব্দ চুরি করেছেন, যা ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া প্রবন্ধে ১৮৫ শব্দ কোট করেছেন তিনি। পুরো প্রবন্ধে অন্যান্য বিষয়ের উৎস নির্দেশেও ব্যর্থ হয়েছেন। কোন গ্রন্থের কোন পৃষ্ঠা থেকে কতটুকু কপি করা হয়েছে, সেটিও অভিযোগে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ফরিদ।

এ ছাড়া তারেক চৌধুরীর বিরুদ্ধে সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন ও অশিক্ষকসূলভ আচরণের অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগে বিভাগের গবেষণা সেমিনারে এমফিল-পিএইচডি গবেষকদের ‘চোর’ বলে সম্বোধন, এক সহকর্মীকে ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ বলে ব্যঙ্গ করা এবং বেয়াদব বলেছেন। সর্বশেষ গত বছরের ২০ মার্চ বিভাগের সেমিনার কক্ষে অধ্যাপক ফরিদের সঙ্গে তিনি অশোভন আচরণ করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, ‘ফরিদ আহমেদ স্যারের দেওয়া অভিযোগে আমার বিষয়ে কিছু কথা লেখা আছে, সেগুলো সত্য। আমার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে অশোভন আচরণ করেছেন অধ্যাপক তারেক চৌধুরী। বাকি বিষয়ে আমি জানি না। প্রশাসন যদি এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য জানতে চায়, তাহলে আমি তাদের সহযোগিতা করব।’

অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক তারেক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমার যে প্রবন্ধের বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটি প্রকাশের সময় এডিটোরিয়াল বোর্ডে ছিলেন অধ্যাপক ফরিদ। জালিয়াতি থাকলে প্রকাশের সময় তিনি অনুমতি দিলেন কেন? অভিযোগে তিনি বারবার লিখেছেন, আমি এত শব্দ চুরি করেছি। কিন্তু শব্দ তো কখনো চুরি হয় না। শব্দ কি আমি বানাব? একই বিষয়ে গবেষণা হলে একজন লেখকের গ্রন্থের শব্দের সঙ্গে আমার লেখা শব্দের মিল থাকতেই পারে। ওনার অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

অশোভন আচরণের বিষয়ে অধ্যাপক তারেক বলেন, ‘আমার গবেষণা ২০১২ সালের, তখন অভিযোগ না করে তিনি এত বছর পর কেন করলেন? ২০১১ সালে বিভাগের সভাপতি থাকতে তিনি তাঁর স্ত্রীকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। যোগ্যতা না থাকায় আমরা প্রতিরোধ করি। এরপর ২০২৩ সালে আবার নিয়োগের সময় তিনি স্ত্রীকে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমাদের জন্য পারেননি। ওই ঘটনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করায় তিনি আমার পেছনে লেগেছেন।’

অধ্যাপক ফরিদ নিজেই নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক তারেক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক ফরিদ ৭ বছরের শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিনা অনুমতিতে ১১ বছর কাটিয়েছেন। বিদেশ থেকে একাধিক মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন। কিন্তু বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি বা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে কোনো থিসিস জমা দেননি। আজ পর্যন্ত তিনি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে এমএ, এমফিল বা পিএইচডি পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীরও দায়িত্ব পালন করেননি। নিয়মিত ক্লাসও নেন না। বিভাগ থেকে প্রশাসনে একাধিকবার অভিযোগ দিলেও ক্ষমতার কারণে তিনি পার পেয়ে যান।

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগপত্রে আমার সব দাবি সত্য। শুধু তা–ই নয়, উনার (তারেক) আরও একটি প্রবন্ধে ৬০ শতাংশ চুরির প্রমাণ মিলেছে, যা দর্শন বিভাগের জার্নালের ১৮ সংখ্যা ২০০১ সালে প্রকাশিত। ওই চুরির বিষয়েও আমি উপাচার্য বরাবর ই–মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করেছি। এখন প্রশাসন যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে।’ তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগের বিষয়ে এখনো তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তদন্ত কমিটি নিয়ে ধোঁয়াশা

১ এপ্রিল সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাপক তারেকের অভিযোগ আমলে নিয়ে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশাসন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানকে সভাপতি ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন–২) এ বি এম আজিজুর রহমানকে সদস্যসচিব করে কমিটিতে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহেদুর রশীদ ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ কাহিলিকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। তাঁদের ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

কমিটির সদস্যদের কাছে এখনো চিঠি পাঠানো হয়নি। তদন্ত কমিটির বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। সিন্ডিকেট সভার একাধিক সদস্য তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়ে নিশ্চিত করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হাসান অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি।