মানিকগঞ্জের শিবালয়ের স্নাতক (পাস) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাসেল মিয়া (২২)। সম্প্রতি তিনি পাসপোর্ট করতে পাসপোর্ট কার্যালয়ে আবেদন করেন। তবে আবেদনে ভুল ধরে তাঁকে বাইরের কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে সংশোধন করতে বলেন পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা। পরে ওই দোকানে থাকা এক দালালকে ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে আবেদনপত্রটি পাসপোর্ট কার্যালয়ে জমা দেন তিনি।
রাসেল মিয়ার বাড়ি শিবালয়ের নবগ্রাম এলাকায়। গত সোমবার কথা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আরিচায় একটি ব্যাংকে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা জমা দেওয়ার পর পাসপোর্টের আবেদনপত্র জমা দিতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল আছে বলে এক কর্মকর্তা বাইরে থেকে যাচাই–বাছাই করে আনতে বলেন। পাসপোর্ট অফিসের সামনে এক কম্পিউটার দোকানে গিয়ে বিষয়টি জানালে এক ব্যক্তি (দালাল) সব ঠিক করে দেবেন বলে জানান। এরপর ওই ব্যক্তিকে ১ হাজার ২০০ টাকা দিলে আবেদনপত্রে কী যেন একটা দাগ দিয়ে দেন। পরে কার্যালয়ে গেলে ওই আবেদনপত্রই জমা নেওয়া হয় এবং ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়।
মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে দালালদের দৌরাত্ম্য ও কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনৈতিক তৎপরতার কারণে পাসপোর্ট করতে গিয়ে রাসেলের মতো সেবাপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিতে তাঁদের সরকারের নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত এক থেকে তিন হাজার টাকা লাগছে।
সেবাগ্রহীতাদের দাবি, নিজেরা পাসপোর্টের আবেদন করলে কোনো না কোনো ভুল ধরে তাঁদের হয়রানি করা হয়। কিন্তু দালালের মাধ্যমে করলে সহজেই আবেদন জমা নেওয়া হয়। এর জন্য দালালদের এক থেকে দুই হাজার টাকা দিতে হয়। অতিরিক্ত এই টাকার কিছু দালালেরা পান এবং অধিকাংশ টাকা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হয়ে থাকে।
২০২০ সালের ১৮ মার্চ জেলা শহরের পশ্চিম বান্দুটিয়া এলাকায় নতুন ভবনে কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকে এই ভবনেই কার্যক্রম চলে আসছে। এর আগে শহরের বেউথা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় জেলা পাসপোর্ট কার্যালয়ের কার্যক্রম চলত। রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সকাল নয়টা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত আবেদনপত্র জমা নেওয়া হয়।
পাসপোর্ট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৪৮ পাতার ৫ বছর মেয়াদি নতুন ই-পাসপোর্টের জন্য ৪ হাজার ২৫০ টাকা এবং ১০ বছর মেয়াদের জন্য ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, জরুরি ৬ হাজার ৩২৫ টাকা এবং অতীব জরুরি পাসপোর্টের জন্য ৮ হাজার ৬২৫ টাকা লাগে। আর ৪৮ পৃষ্ঠার ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের জন্য ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, জরুরি ৮ হাজার ৫০ টাকা এবং অতীব জরুরির জন্য লাগবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা। এ ছাড়া ৬৪ পৃষ্ঠার ৫ বছর মেয়াদের জন্য ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, জরুরি ৮ হাজার ৬২৫ টাকা ও অতীব জরুরি পাসপোর্টের জন্য ১০ হাজার ৩৫০ টাকা গুনতে হবে। আর ৬৪ পৃষ্ঠার ১০ বছর মেয়াদের জন্য ৮ হাজার ৫০ টাকা, জরুরি ১০ হাজার ৩৫০ টাকা এবং অতীব জরুরি পাসপোর্টের জন্য ১২ হাজার ৬৫০ টাকা লাগে।
গত বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) ও রোববার (২৯ জুন) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনে ও আশপাশে অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি কম্পিউটার কম্পোজের দোকান আছে। এসব দোকান ও পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনে দালালেরা ওত পেতে থাকেন। কোনো সেবাপ্রার্থী আবেদন করতে এলে তাঁদের নিজ নিজ কম্পিউটারের দোকানে নিয়ে যান। দালালদের মাধ্যমে আবেদন করলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই তা জমা নেওয়া হয়। তবে সেবাপ্রার্থীরা নিজেরা আবেদন জমা দিতে গেলে বিভিন্ন ভুল ধরে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে তাঁরা কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে দালালদের শরণাপন্ন হন।
কার্যালয়ের সামনে সড়কের দক্ষিণ পাশে ভাই ভাই টেলিকম ও ফুয়াদ মুয়াদ ফটোকপি অ্যান্ড স্টেশনারি নামের দুটি দোকানে পাসপোর্ট করতে আসা সেবাগ্রহীতাদের আবেদন লেখাতে ভিড় দেখা যায়।
ভাই ভাই টেলিকম নামের কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে বসে থাকা এক দালালের সঙ্গে পাসপোর্ট করতে আসা এক তরুণ তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবার নামে ভুল থাকার বিষয়ে আলাপ করছিলেন। এ সময় ওই দালাল বলছিলেন, ‘কিছু ট্যাকা বেশি লাগবে। সব কাজ হয়ে যাবে।’ এ সময় টাকার পরিমাণ জানতে চাইলে দালাল বলছিলেন, ‘ব্যাংক ড্রাফট বাদে আরও দুই হাজার টাকা লাগবে।’ পরে সেবাগ্রহীতা রাজি হয়ে যান।
পাসপোর্ট অফিসের সামনে একটি চায়ের দোকানে কথা হয় এক দালালের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি (৪৫) বলেন, ‘পাসপোর্ট করতে আসা লোকজনকে আমরা সহযোগিতা করি। দিনে একটি-দুটি কাজ করতে পারি। কাজ কইর্যা দুই-চার শ টাকা পাই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, পাসপোর্ট অফিস থেকে শুরু করে সরকারি সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন দালালদের দৌরাত্ম্য। সেবাগ্রহীতারা নিজেরা পাসপোর্ট করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন। এ কারণে সেবাগ্রহীতারা দালালদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন। এ সুযোগে দালালেরা সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা-পয়সা নিচ্ছেন। প্রশাসনের এ ব্যাপারে নজর দিতে হবে।
দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক অরূপ রতন চাকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার নজরে ছিল না। এ ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নেব।’ দালালদের সঙ্গে কার্যালয়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস করানোর জন্য মানুষ অনেক কিছুই বলেন। তারপরও বিষয়টি নজরে নেব।’