রাঙামাটিতে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা নেই

শয্যাসংকটের ফলে মেঝেতে ঠাসাঠাসি করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। সম্প্রতি রাঙামাটি আধুনিক সদর হাসপাতালেছবি: সুপ্রিয় চাকমা

রাঙামাটি আধুনিক সদর হাসপাতাল চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। চার দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য এখানে নেই আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র), সিসিইউ (করোনারি কেয়ার ইউনিট) বা ডায়ালাইসিস ইউনিট।

ফলে হৃদ্‌রোগ, কিডনির রোগ বা গুরুতর অবস্থায় থাকা রোগীদের পাঠাতে (রেফার) হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, যার দূরত্ব রাঙামাটি সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে যেতে হয় রাজধানী ঢাকাতেও। চিকিৎসকেরা জানান, প্রতি মাসে ১০০ থেকে ১৫০ রোগীকে পাঠাতে হয়, যা প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ জন।

পাহাড়ি ও প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রোগী নিয়ে চট্টগ্রাম বা ঢাকায় যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচ ও মানসিক চাপ—সব মিলিয়ে সংকটে পড়েন স্বজনেরা।

রাঙামাটির ১০ উপজেলার প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের ভরসা এই সদর হাসপাতাল, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘জেনারেল হাসপাতাল’ নামে। ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকেন ২০০ থেকে ২৫০ জন। শয্যা কম থাকায় অনেক সময় রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়।

৮ জুলাই সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের নারী ও শিশু ওয়ার্ডের সাধারণ শয্যা—সব কটিতে রোগী। এর বাইরেও দুই ওয়ার্ডেই মেঝেতে ছিল রোগী। বিশেষ করে শিশু ওয়ার্ডে মেঝেতে শয্যা বিছিয়ে রাখা হয় শিশুদের। অসুস্থ শিশুদের পাশে ছিলেন স্বজনেরাও।

এক রোগীর স্বামী জানান, তাঁর স্ত্রীর শ্বাসকষ্টের সমস্যা হচ্ছিল। তাই হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তবে রোগীর চাপ থাকায় শয্যা পাননি। পরে মেঝেতে শয্যা দেওয়া হয়। তবে চিকিৎসকেরা নিয়মিত দেখছেন।

চার বছর আগে হাসপাতালের দোতলা ভবনটি সম্প্রসারণ করে টিনের ছাউনিতে তিনতলা করা হয়। ওই অংশে বর্তমানে নারী, শিশু ও প্রসূতি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

রাঙামাটি আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শওকত আকবর প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন বহির্বিভাগে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জন এবং অন্তর্বিভাগে ২০০-২৫০ জন চিকিৎসা নেন। হাসপাতালে জনবলসংকট রয়েছে। ৩১টি চিকিৎসকের পদ থাকলেও আছেন ২২ জন। তারপরও চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখেছেন তাঁরা। তবে সবচেয়ে বেশি সংকট রয়েছে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে।

সিসিইউ ভবন এখন কলেজ

২০০৯ সালে হাসপাতালের পাশে নির্মাণ করা হয় ছয়তলা একটি ভবন, যেখানে হৃদ্‌রোগীদের জন্য সিসিইউ চালুর কথা ছিল। কিন্তু ভবনটি আর ব্যবহার করা হয়নি চিকিৎসাকাজে।

২০১৫ সাল থেকে ওই ভবনে চলছে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী কার্যক্রম। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ শেষ হয়নি। প্রকল্প অনুমোদন থাকলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ২০২৮ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। তবে সময়মতো স্থায়ী ক্যাম্পাস হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

রাঙামাটিতে আইসিইউ, সিসিইউ ও ডায়ালাইসিস ইউনিট চালু এবং শয্যা বাড়াতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি ১১ তলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তৎকালীন সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার এ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও গণপূর্ত অধিদপ্তর।

এরই মধ্যে ভবনের ছয়তলা অংশের নির্মাণ শেষ হয়েছে, তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনো ভবনটি বুঝে পায়নি। চলতি বছরের মধ্যেও হস্তান্তর হওয়ার সম্ভাবনা কম। গত বছরের জুনে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

চিকিৎসকেরা জানান, শুধু ভবন হলেই হবে না। ­চিকিৎসা সরঞ্জাম, আসবাব, প্রয়োজনীয় জনবল—সবকিছু ছাড়া সেবা চালু সম্ভব নয়। নতুন শয্যার জন্য জনবল–কাঠামোর অনুমোদনও প্রয়োজন।

ভরসা ৬০ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম

প্রায় আট মাস আগে তীব্র পেটব্যথা শুরু হয় আতিফ চাকমার। রাঙামাটির প্রত্যন্ত জুরাছড়ির এই বাসিন্দাকে নৌযানে করে রাঙামাটি সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনেরা। তীব্র ব্যথা ও যন্ত্রণা নিয়ে এই হাসপাতালে আসার পর মনে করেছিলেন, একটু স্বস্তি পাবেন। কিন্তু হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ফলে আবার ছুটতে হয় চট্টগ্রামের উদ্দেশে।

আতিফ চাকমার স্বজন রিপন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চ বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে জুরাছড়ি থেকে রাঙামাটি শহরে আসতে দু-তিন ঘণ্টা লেগে যায়। এরপর চট্টগ্রামে নিয়ে যান। সেখানে চার দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সুস্থ হন আতিফ।

কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়ে দেড় বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন দোকানি রাসেল চাকমা। রাঙামাটি শহরের কালিন্দীপুরের এই বাসিন্দা প্রতি সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস করতে চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে আসেন। প্রতি সপ্তাহে চিকিৎসা ও আসা-যাওয়ায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। একবার যাওয়া-আসা করতে ৫-৬ ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে এভাবে যাতায়াত করা খুব কষ্ট হয়ে যায়। রাসেল চাকমা বলেন, ‘এখন যদি রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সুবিধা থাকত, তাহলে যাতায়াতের ধকল থেকে বাঁচতাম। এ ছাড়া ৭-৮ হাজার টাকা বেঁচে যেত।’

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শওকত আকবর প্রথম আলোকে বলেন, জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ, সিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবা চালু থাকলে এই অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হতো। কিন্তু বাধ্য হয়ে এ ধরনের রোগী এলে তাঁদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করতে হয়।