টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় দরকার পরিকল্পিত উদ্যোগ 

হাওর এলাকার ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ হাওরের ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের বাদ দিয়ে হাওরের উন্নয়ন সম্ভব নয়। 

সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সম্পদ, সম্ভাবনা আর অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এই জলাভূমির প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নানা সময় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। পরিবেশবান্ধব পর্যটনের কোনো ব্যবস্থাও নেই এখানে। পরিবেশবিদেরা বলেন, হাওরের উন্নয়নে দরকার পরিকল্পিত উদ্যোগ। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হাওরপারের লোকজনকেও ভূমিকা রাখতে হবে। 

হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের জন্য একটি আন্তরিক কর্তৃপক্ষ দরকার। বিকল্প জ্বালানি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে হাওরে সম্পদ ও পরিবেশের ওপর মানুষের অত্যাচার বন্ধ হবে না। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওর আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’। এই হাওর ১৮ বছর ধরে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হাওরের সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। একসময় হাওরের সম্পদ পাহারায় একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা চারটি ক্যাম্পে থেকে সার্বক্ষণিক কাজ করতেন। এখন ম্যাজিস্ট্রেট–পুলিশ নেই। তবে কয়েকজন আনসার রয়েছেন। 

সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় এই হাওরের অবস্থান। দুই উপজেলার চার ইউনিয়নের ১৮টি মৌজা মিলে হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট-বড় ১০৯টি বিল আছে। তবে প্রধান বিল ৫৪টি। হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। হাওর এলাকার ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাওরের উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। এই পাহাড় থেকে ৩৮টি ঝরনা নেমে এসে মিশেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।

প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে ইজারা প্রথা বাতিলের পর ২০০৩ সালের ১০ নভেম্বর হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। এরপর প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে থেকে হাওরে ‘সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ শুরু করে। ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়।

টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয় দেশি মাছের আধার। জলজ প্রাকৃতিক বন, পরিযায়ী ও দেশি পাখির নিরাপদ আবাস্থল। প্রতি বছর শীত মৌসুমে দেশি ও পরিযায়ী লাখো পাখির মেলা বসে এখানে। দীর্ঘদিন পানির নিচেও টিকে থাকতে পারে এমন কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ আছে এখানে। হাওরে ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা ২৬ প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাসভূমিও এই হাওর। 

তবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, এসব পরিসংখ্যানের সঙ্গে এখন বাস্তবতার মিল নেই। এখন গাছ, মাছ, পাখি সবই কমছে। হাওরে অবাধে গাছ কাটা, মাছ ধরা চলে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে লাখো পর্যটক আসেন হাওরে। পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত এবং বর্ষায় পর্যটকবাহী বড় বড় নৌকা চলে হাওরে। তাঁরা নৌকা থেকে প্লাস্টিকের বোতল থেকে শুরু করে কফ-থুতুসহ নানা ধরনের আবর্জনা ফেলেন। এই হাওরে আগে ফসল হতো না। এখন কোনো বিলে বোরো আবাদ হওয়ায় হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কারণে ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের। 

হাওরপারের গোলাবাড়ি গ্রামের হাসেম আলী জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরে কোনো ফসল হয় না। মানুষ মাছ ধরেই জীবন চালান। বিকল্প কাজ না দিয়ে শুধু কথা বলে পরিস্থিতি পাল্টানো যাবে না। একই গ্রামের মাজেদা বেগম বলেন, ‘সবাই কয় মাছ না ধরতে, গাছ না কাটতে। মাছ না ধরলে খাইমু কী আর গাছ না কাটলে রানমু কী দিয়া!’

দীর্ঘ সময়ের সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কোনো সফলতা আসেনি উল্লেখ করে ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে এখন যেভাবে আছে, সেটা অনেকটা অভিভাবকহীন। এভাবে চলতে থাকলে হাওরের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বললেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওর ভালো নেই। নতুন করে ভাবতে হবে। অতীতে বড় বড় প্রকল্পের নামে যা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। এসব বন্ধ করতে হবে।’

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুপ্রভাত চাকমা বলেন, প্রশাসনও ভাবছে কীভাবে হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সম্পদ রক্ষায় আরও বেশি কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যায়। পর্যটনের বিষয়টি নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। সবার আগে হাওর, হাওরে প্রকৃতি ও পরিবেশ। ভবিষ্যতে যা কিছু হবে, এসব চিন্তা-ভাবনা করেই হবে।