অজন্তা ইলোরার দারোয়ান

মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্য আবিষ্কার করেছেন, সংগ্রহ করেছেন, সেগুলোর পাঠোদ্ধার ও সুসম্পাদনা করে বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন।

আবদুল করিম

১৯৪৮ সাল। যুবক কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান একবার তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে ঢাকা থেকে এসেছিলেন সাহিত্যবিশারদকে দেখতে। তখন তাঁর বয়স ৭৭ বছর। চট্টগ্রাম শহরের বটতলী স্টেশন থেকে দোহাজারী লাইনের ট্রেনে চেপে তিনি গিয়েছিলেন পটিয়া স্টেশনে। সেখান থেকে হেঁটে বিভিন্নজনের কাছে জিজ্ঞেস করে পথ চিনে পৌঁছেছিলেন চাটগাঁর সেই তীর্থভূমিতে। দুর্ভিক্ষপীড়িত সেই সময়েও তাঁকে টেনেছিল সেই তীর্থভূমি। পরে স্মৃতিচারণায় শওকত ওসমান লিখেছিলেন, ‘বিনয়, উদারতা নিরাভরণ জীবনযাপনের অতীতের এক দরবেশকে দেখলাম সেদিন সুচক্রদণ্ডী গ্রামের নিরাভরণ দহলিজের কক্ষে।’ শওকত ওসমানের এই স্মৃতিচারণের মধ্যে মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ব্যক্তিত্বের যথার্থ চিত্রটা ফুটে ওঠে। সাহিত্যবিশারদের সাহিত্যসাধনা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘বিংশ শতকের মানুষ মুনশী আবদুল করিম। দেশপ্রেম তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সুদূর অতীতের মণিরাজির সন্ধানে।’

মুনশি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্য আবিষ্কার করেছেন, সংগ্রহ করেছেন, সেগুলোর পাঠোদ্ধার ও সুসম্পাদনা করে বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। সাহিত্যের সেই প্রাচীন সম্পদকে তিনি আমাদের অজন্তা ইলোরা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এই অজন্তা ইলোরার দারোয়ান হয়ে রইলাম’—এই উক্তি তাঁর শেষ জীবনের। নিজের পুরোটা জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন বাংলা সাহিত্যের মণিমাণিক্যের খোঁজে। পুরোনো পুঁথির এক বিরাট ভান্ডারে পরিণত হয়েছিল তাঁর বাড়ি। তিনি বলতেন, ‘আমার ছেলেপুলে নেই। এরাই আমার সব, এই পুঁথিরাই আমার সব। কত কষ্ট করে যে এদের বাঁচিয়ে রেখেছি পোকার হাত থেকে, বর্ষার জুলুম থেকে, আমিই জানি। বছরে ৫–১০ টাকা আমার এর পেছনে যায়।’

সাহিত্যবিশারদ সম্পর্কে সাহিত্যিক আবুল ফজলের স্মৃতিচারণে তাঁর আরও নিখুঁত একটা প্রতিকৃতি আমরা পাই। এই স্মৃতিচারণে ব্যক্তি আবদুল করিম যেমন উঠে আসেন, তেমনি সাহিত্যসাধক আবদুল করিমেরও যথার্থ মূল্যায়ন হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘সাহিত্যসাধনাকে তিনি কোনোদিন অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে করেননি ব্যবহার। তিনি ছিলেন খাঁটি সাহিত্যসাধক। সাহিত্যের যেখানে যা কিছু উপকরণ দেখেছেন, পেয়েছেন, তা–ই সংগ্রহ করেছেন প্রাণপণ যত্নে, আগলে রেখেছেন যক্ষের ধনের মতো। নতুন–পুরোনো যা কিছু সাহিত্যসম্পদ তাঁর হাতে পড়েছে, তা–ই তিনি সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছেন, কিছুরই অপচয় হতে দেননি। এ কথা বোধকরি জোর করে বলা যায়, তাঁর সংগৃহীত গ্রন্থের সাহায্য ছাড়া আমাদের সাহিত্যের কোনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসই রচিত হতে পারবে না।’ আবুল ফজলের এই মন্তব্যের মধ্যেই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সারা জীবনের সাধনা, নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা আর সাফল্যের কথা উঠে এসেছে। একটা জীবন সাহিত্যের সেবায় কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। এজন্যই দুই বাংলার পণ্ডিতসমাজ, সাহিত্যপ্রেমীরা এখনও তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ১৮৪৫ সালে পটিয়ায় প্রথম ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হওয়ার পর সেই স্কুলে প্রথম মুসলমান ছাত্র ছিলেন আবদুল করিম। তিনি ছিলেন প্রথম মুসলমান ম্যাট্রিকুলেট। তাঁর সম্পর্কে মাহবুব উল আলম নিজের স্মৃতিচারণায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘নিকটে পাহাড়ের মৌন ভাষা, অদূরে সমুদ্রের শোঁ শোঁ গর্জন চট্টগ্রামী চরিত্রকে হাজার বছরের এক সহজ কবিত্বের উত্তরাধিকারী করে রেখেছে। প্রত্যেক চট্টগ্রামীর বুকে-তার কানে একরূপ গান সব সময় বাজতে থাকে। আবদুল করিম ছিলেন সেই চট্টগ্রামী চরিত্রের প্রতীক।’ এ কারণেই হয়তো তিনি শিক্ষিত হয়েও চট্টগ্রামের নিজ গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাননি। সেখানেই তিনি শিক্ষকতা করেছেন, সরকারি অফিসে কেরানির চাকরি করেছেন। দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল, কিন্তু বিরামহীন সাহিত্য সাধনায় তিনি লিপ্ত ছিলেন। প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ধরনা দিয়েছেন। শুধু সংগ্রহ নয়, এসব পুঁথির মধ্যে কী লেখা আছে তা পাঠোদ্ধার করার কাজেও লেগেছেন। এই জন্যই হয়তো তাঁর সম্পর্কে শওকত ওসমান বলেছেন, ‘তিনি চাটগাঁর সবচেয়ে বড়লোক হলেও গরিব। ঐশ্বর্যশালী তবু বিত্তহীন।’

পটিয়ার সূচক্রদণ্ডী গ্রামের এই বাড়িতেই থাকতেন সাহিত্য বিশারদ
ছবি: আব্দুর রাজ্জাক

সাহিত্যবিশারদ সম্পর্কে আমাদের দেশের বরেণ্য পণ্ডিতেরা যে গুণকীর্তন করেছেন, তার যথেষ্ট যৌক্তিক ইতিহাস ও কারণ আছে। এ দেশের মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার একটি বিরাট ভিত তৈরি করেছিলেন তিনি। রাজনীতিবিদ আসহাব উদ্দিন আহমদ বলেছেন ‘আমাদের অতীত আবিষ্কারের জন্য তিনি কলম্বাসের সঙ্গে তুলনীয়। তাঁর এই অবদানের তুলনা নেই। জাতির কাছে তাঁর ঋণ অপরিশোধ্য।’

আবদুল করিম তাঁর সারা জীবনে কমপক্ষে ১৫০ জন কবির প্রাচীন পুঁথি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি সংযোজন করেছেন প্রায় ৪০০ বছরের সাহিত্যিক নিদর্শন। পনেরো শতকের গুরুত্বপূর্ণ কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর, ষোলো শতকের দৌলত উজির বাহরাম খান, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ, সতেরো শতকের কাজী দৌলত, মাগন ঠাকুর, আলাওল, আঠারো শতকের আলী রজাকে তিনিই আবিষ্কার করেছেন। এ ছাড়া ষোলো শতকের দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, গোবিন্দ দাসসহ ত্রিশোর্ধ্ব হিন্দু কবিও রয়েছেন, যাঁদের পুঁথি ও পদের তিনিই প্রথম আবিষ্কর্তা। সাহিত্যবিশারদের ভাইপো আহমদ শরীফ বলেছেন, ‘পাঁচ-ছয় শতাধিক পুঁথি পরিচায়ক ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও ভূমিকা লিখেছেন, লিখেছেন ইতিহাসবিষয়ক প্রবন্ধ, গ্রন্থ সমালোচনা কিংবা পুস্তক পরিচিতি।’ নিজের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রাচীন পুঁথির সন্ধান ও আবিষ্কার আমার যেন ধ্যানের বস্তু হইয়া ওঠে। সারা জীবন আমি ধ্যাননিমগ্ন যোগীর ন্যায় সেই এক ধ্যানেই কাটাইয়াছি।’ তাঁর সারা জীবনের সেই ধ্যান, সেই সাধনায় তিনি সফল হয়েছেন। সেই স্বীকৃতি তিনি জীবদ্দশাতেই পেয়েছেন। সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত নরোত্তম ঠাকুরের রাধিকার মান ভঙ্গ নামে একটি বইয়ের ভূমিকায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের আবিষ্কারক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘তিনি এই দুর্লভ গ্রন্থের সম্পাদন কার্যে যে রূপ পরিশ্রম, যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহৃদয়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা সমস্ত বাংলায় কেন, সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। এক-একবার মনে হয় যেন কোন জর্মান এডিটার এই গ্রন্থ সম্পাদন করিয়াছেন।’ এই প্রশংসা, এই স্বীকৃতিতে তিনি গর্ববোধ করতেন না। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতেন—‘পুরাতন কঙ্কালের মধ্যে জীব-বৈজ্ঞানিকের মতো আামার জিন্দেগি কাটিয়াছে। কীটদৃষ্ট পুঁথি, তালপাতা আর তুলট কাগজ আমার সাহিত্য সাধনার সম্বল।’ এই কথায় তাঁর বিনয় যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি নিজের কাজের প্রতি তাঁর প্রত্যয়ও ব্যক্ত হয়েছে। আর এই কাজের জন্য জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করেছেন। উৎসর্গ করেছেন ধনদৌলত, অর্থবিত্তের লোভ। সচ্ছলতা কী বিষয় তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। শেষ জীবনে যখন শ্রবণশক্তি বিলোপ হয়ে গেছে, চলতে ফিরতে পারতেন না, তখন সাহিত্যিক আবুল ফজলের কাছে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সম্প্রতি আমার সুখ দুঃখভাগিনী স্ত্রীও আমাকে অকূলে ভাসাইয়া গিয়াছেন। এখন আমি পুত্রকন্যাহীন, ভাইভগ্নিবিরহিত স্রোতের শেওলার মতো ভাসমান। আমি সম্পূর্ণ অসহায় ঠিক একটা অপোগন্ড শিশুর মতো। ...কোনোরূপ বাঁচিয়া আছি। আমি আরও কিছুদিন বাঁচিলে এভাবে অসহায় নিঃসঙ্গ জীবন কীরূপে কাটাইব ভাবিতেছি।’ এই চিঠি মৃত্যুর কয়েক দিন আগে লিখেছিলেন। আবুল ফজল তাঁর খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাই তাঁর কাছে নিজের দুর্দশার কথা প্রকাশ করেছেন। জীবনের একেবারে শেষ দিকে আবুল ফজলের বাসায় কয়েক দিন এসে থেকে গেছেন। তখন একেবার শেষ অবস্থা তাঁর। ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুর পর অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজও তিনি প্রাসঙ্গিক। কারণ, তিনি সমাজকে আলোকিত করেছেন। তিনি ধর্ম–শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। সারা জীবন তাঁর চিন্তা–চেতনায়–কর্মে আচরণে জাত-বর্ণ-ধর্ম বা আর্থিক অবস্থানভেদের জন্য ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রকাশ পায়নি। তার মানবিকতার জন্য তিনি মানুষের কাছে; আর গবেষণা ও সাহিত্যসাধনার জন্য তিনি বিদগ্ধজনের কাছে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

ওমর কায়সার, কবি ও প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক