অনলাইন ক্লাসের সুফল পাচ্ছে না সীমান্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা

সীমান্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাসের সুযোগ কম পাচ্ছে
সংগৃহীত

নিবিড় সারোয়ার রংপুর সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। করোনার কারণে তার কলেজ বন্ধ হওয়ায় সে বাড়ি চলে এসেছে। অনলাইনে ক্লাস করতে কেনে একটি স্মার্টফোন। কিন্তু মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ভালো না থাকায় সে ক্লাস করতে পারেনি।
নিবিড়ের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর বেউরঝারি সীমান্ত এলাকার চড়ুইগাতি গ্রামে। নিবিড় বলে, ‘আমার সহপাঠীরা বাড়িতে অনলাইনে ক্লাস করছে। আমি বাড়িতে এসে বিপাকে পড়েছি। পড়ালেখায় ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক খুব একটা পাওয়া যায় না।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। পরে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে সংসদ টেলিভিশনে অনলাইন ক্লাস চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে চালু করা হয়েছে অনলাইন ক্লাস। কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকায় অনেক শিক্ষার্থীর বাড়িতে টেলিভিশন নেই। দুর্বল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্ত এলাকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইনে শিক্ষার সুফল পাচ্ছে না । ফলে তাঁরা পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ছে।
জেলা তথ্য বাতায়ন সূত্রে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ে ৯১টি মহাবিদ্যালয়, ২৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৩৯টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৬৯টি মাদ্রাসা ও ৯৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
জেলায় ১০৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

অনলাইনে ক্লাশ করার সুযোগ না পাওয়ায় পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা
সংগৃহীত

ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী দুলাল হকের বাড়ি বালিয়াডাঙ্গী মন্ডমালা গ্রামে। তিনি এ প্রতিবেদকের সামনে ১০ জন পথচারীর কাছে জানতে চায়, তাদের বাড়িতে টেলিভিশন ও স্মার্টফোন আছে কি না। এর মধ্যে কারও বাড়িতে স্মার্টফোন নেই এবং দুজনের বাড়িতে টেলিভিশন রয়েছে। দুলাল বলে, যেখানে মানুষের বাড়িতে টেলিভিশন নেই, ভালো মুঠোফোন নেই, সেখানে অনলাইনে ক্লাসের কথা ভাবা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না।

আমাদের সংসারের খরচ সামলাতেই হিমশিম খেতে হয়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য দামি ফোন বা ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার টাকা জোগাড় করা কঠিন।
রোকেয়া বেগম, অভিভাবক

বেউরঝারি এলাকার শারমিন আকতার রত্নাই বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাদের বাড়িতে টেলিভিশন রয়েছে। সংসদ টেলিভিশনে সে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ দেখে। শারমিন জানায়, টেলিভিশনে যখন ক্লাস শুরু হয়, অনেক সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না।

শারমিনের মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘সাড়ে পাঁচ মাস সময় ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ। বাড়িতে ছেলেমেয়েরা তেমন লেখাপড়া করছে না। আমরা শুনেছি, টেলিভিশনে ক্লাস চলছে। শিক্ষকেরাও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের সংসারের খরচ সামলাতেই হিমশিম খেতে হয়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য দামি ফোন বা ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার টাকা জোগাড় করা কঠিন।’

ওই এলাকার বাসিন্দা আবুল হাসানের দুই সন্তান লেখাপড়া করে। তাঁদের বাড়িতে টেলিভিশন বা অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, মুঠোফোন থাকলেও খুব একটা লাভ হতো না। কারণ, এ এলাকায় মুঠোফোনে নেটওয়ার্ক খুব একটা পাওয়া যায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রত্নাই বগুলাবাড়ি স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. লিটন, লিপি আকতার, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী নুপুর আকতার, হরিণমারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির নাজমুল হাসান, হরিণমারি উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী আশামনি গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সংসদ টেলিভিশনে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ শিরোনামে প্রচারিত পাঠদানের একটি অনুষ্ঠানও দেখেনি।

রত্নাই বগুলাবাড়ি স্কুল ও কলেজের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী বলেন, দেশের শহরাঞ্চলের সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থীরাই কেবল অনলাইনে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু সীমান্তের শিক্ষার্থীরা এ সুবিধা পাচ্ছে না। ফলে লেখাপড়ায় তাদের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে।

ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের বিদায়ী অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া মন্ডল বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সীমান্তের শিক্ষার্থীরা অনলাইনের ক্লাসের সুবিধা নিতে পারছে না। দীর্ঘদিন লেখাপড়ার চর্চায় না থাকায় তাদের ঝরে পড়া ও বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকছে। এটাও এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার আলাউদ্দীন আল আজাদ বলেন, সীমান্ত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সেখানকার শিক্ষার্থীরা টেলিভিশন ও অনলাইন ক্লাসের সুফল খুব একটা পাচ্ছে না—এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সব শিক্ষার্থীর উচিত, যেকোনো উপায়ে এসব ক্লাসে যুক্ত থাকা।