অনাথ শিশুদের পেয়ে ‘বাঁচার স্বপ্ন’ তাঁদের

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা এলাকায় অনাথ শিশুদের জন্য আবাসস্থল। শনিবার সন্ধ্যায় তোলা ছবি
ছবি: প্রথম আলো

বরিশালের একটি উপজেলায় বাড়ি এক দম্পতির। ওষুধের ব্যবসা আছে; অর্থকড়ির কমতি নেই। কিন্তু বিয়ের বয়স ১৯ পেরোলেও ঘরে আসেনি কোনো সন্তান। চিকিৎসকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ব্যয় করেছেন প্রায় ২০ লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টাই বৃথা হয়েছে। নিঃসন্তান এই দম্পতি সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বরিশাল বেবিহোমসে আশ্রিত এক শিশুকে দত্তক পেয়ে ভিন্ন জীবন শুরু করেছেন তাঁরা।

ওই দম্পতি গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শিশু আদালতের আদেশে তিন মাস বয়সী ছেলেশিশুটিকে দত্তক পান। তার বয়স এখন এক বছরের কিছু বেশি। মা–বাবার আদর-স্নেহে শিশুটি বেড়ে উঠছে। ওষুধ ব্যবসায়ী ওই ব্যক্তি রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনের সব আশাই নিভে গিয়েছিল। তখন আমাদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে দত্তক নেওয়া শিশুটি। ওর হাসিমাখা মুখ দেখে প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে। আমি বোঝাতে পারব না ও আমাদের কাছে কত বড় সম্পদ।’

বরিশাল বেবিহোমসের এমন ১৩টি অনাথ ও পিতৃপরিচয়হীন শিশু নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে। তারা এখন মা–বাবার স্নেহ-মমতায় বেড়ে উঠছে। বিকশিত হচ্ছে পারিবারিক আবহে। আদালতের কাছ থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় ওই শিশুদের দত্তক নিয়েছে ১৩টি নিঃসন্তান পরিবার। এসব পরিবারে ফিরেছে স্বাভাবিক ছন্দ।

বরিশাল শিশু আদালত সূত্র জানায়, ১৭ মার্চ শিশু দিবসে বরিশাল জেলা জজ আদালতের সম্মেলনকক্ষে এই ১৩টি শিশু এবং তাদের বাবা-মাদের মিলনমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে জেলা শিশু আদালতের বিচারক আবু শামীম আজাদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি উচ্ছ্বসিত শিশু ও অভিভাবকদের দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। খোঁজখবর নেন এবং দত্তক নেওয়া মা–বাবার অনুভূতি শোনেন। ওই বাবা-মাদের হাসি-আনন্দমাখা মুখচ্ছবিই বলে দিচ্ছিল জীবনের সব হতাশা, গ্লানি ছাপিয়ে তাঁরা নতুন করে এক ভিন্নতর জীবন শুরু করেছেন। বিচারক আবু শামীম আজাদ এসব শিশুর আইনিভাবে অভিভাবকত্ব দিয়েছেন।

এমন আরেক দম্পতির বাড়ি পটুয়াখালীতে। গৃহকর্তা একটি বেসরকারি সংস্থার চাকরিজীবী; তাঁর স্ত্রী গৃহিণী। ১৪ বছরের দাম্পত্য জীবনে সন্তানের দেখা পাননি। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালতের মাধ্যমে ছয় মাস বয়সী এক শিশুকে দত্তক নেন। তার বয়স এখন দুই বছরের বেশি। এই গৃহবধূ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আসলে কাউকে নিরাশ করেন না। ও (শিশুটি) আমাদের জীবনের আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আমাদের সব স্বপ্ন বেঁচে থাকা এখন ওকে ঘিরেই।’

এই ১৩ দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তাঁদের সাংসারিক জীবনের অতৃপ্তি ঘুচিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান একজন মানুষের। মূলত তিনিই খুঁজে খুঁজে নিঃসন্তান দম্পতিদের বের করে নিখুঁতভাবে তাঁদের পারিবারিক, আর্থিক, সামাজিক অবস্থান যাচাই-বাছাই করে নিভৃতে অনাথ শিশুদের এমন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছেন। তিনি বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ। ওই ১৩টি অনাথ শিশু ও তাদের দত্তক নেওয়া দম্পতিদের নিয়ে ১৭ মার্চের মিলনমেলার উদ্যোক্তা ছিলেন তিনিই। সাজ্জাদ পারভেজ ব্যক্তিগত অর্থে শিশুদের দিয়েছেন নানা ধরনের উপহার। ফোন করে তিনি প্রায় দিনই বাচ্চাদের খোঁজখবর নেন।

সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ‘কাজটি আমি নিজের ইচ্ছায়-উদ্যোগেই করছি। যখন আমি বেবিহোমসে যাই, তখন নিষ্পাপ এসব শিশুর হাসিমাখা মুখ দেখি। বাসায় ফিরে যখন নিজের সন্তানের মুখের দিকে তাকাই, তখন বুকটার ভেতরে একধরনের হাহাকার অনুভব হতো। বেবিহোমসের শিশুদের অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে বুকটা ভারাক্রান্ত হতো। এরপরই আমি এসব শিশুর ভালো আশ্রয়ের খোঁজে নেমেছিলাম। খুঁজে খুঁজে বের করেছি নিঃসন্তান দম্পতিদের।’