অনিশ্চিত জীবন, উপকূল ছাড়ছে মানুষ

বারবার দুর্যোগে জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বসতবাড়ি হারানো মানুষ এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছে শহরে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ভেঙে যায় সাতক্ষীরা উপকূলের বেশ কিছু বাঁধ। নদীগর্ভে চলে যায় মানুষের ঘরবাড়ি। বাঁধের ওপর বসবাস করা একটি পরিবার। গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কুড়িকাহনিয়ায়ছবি: সাদ্দাম হোসেন

পড়ন্ত বিকেলে সুন্দরবনের কাছে শাকবাড়িয়া নদীর তীরে একা বসে ছিলেন প্রমীলা মণ্ডল। দৃষ্টি নিজের পুরোনো বসতভিটার দিকে, যেটি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর পানিতে তলিয়ে যায়।

৪৫ বছর বয়সী এই নারী জানান, তাঁর জীবনেই বহুবার নিজেদের ঘর ভাঙতে দেখেছেন। কয়বার—সেটি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারলেন না। গত মে মাসে আম্পানের পর বসতবাড়ি হারিয়ে একটি ঘেরের পাশে ঘর তুলে বাস করছে তাঁর পরিবার। আবার ঝড় এলে সেটিও থাকবে কি না, সেই শঙ্কা উঠে এল তাঁর কথায়।

প্রমীলা খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি যে বাঁধটির ওপর বসে ছিলেন, সেটি নতুন করে তৈরি। ৩০০ গজের মতো দূরে আরেকটি বাঁধ ছিল, সেটির ধারেই ছিল তাঁদের বাড়ি। সেখানে এখনো বসতভিটার কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে, যা ভাটার সময় দেখা যায়।

উপকূলবাসীর এলাকা ছাড়ার প্রধান কারণ বসবাসের অনিশ্চয়তা। টেকসই বাঁধ হলে মানুষ অন্তত নিজের ভিটায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। সেই নিশ্চয়তা পেলে এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে।
আইনুন নিশাত, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাকবিশ্ববিদ্যালয়

দেড় দশকে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন এবং সর্বশেষ আম্পানের আঘাতে প্রমীলাদের মতো উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। একসময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো জমি ও সম্পদ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত খুলনা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকার অন্তত ১০টি ইউনিয়নের ৩০টির বেশি গ্রাম ঘুরে দেখা যায় মানুষের জীবনসংগ্রামের চিত্র। জনপদে ঘোরার সময় প্রায় সবার মুখেই শোনা গেল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। স্থানীয়রা আরও জানান, দুর্যোগে টিকতে না পেরে অনেকে এলাকা ছেড়েছেন। অনেকে ছাড়ার পথে রয়েছেন।

প্রমীলা মণ্ডলের সঙ্গে আলাপ হয় গত ২৮ সেপ্টেম্বর। তিনি যে বাঁধটির ওপর বসে ছিলেন, তার পাশেই গোলপাতা আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট কুঁড়েঘর। কিছু কিছু আবার পাকা। দেখেই বোঝা যায় ঘরগুলো নতুন। সেগুলো আম্পানের আঘাতের পর তৈরি হয়েছে। মিঠাপানির কারণে আংটিহারা গ্রামের চারপাশে গাছপালা ভরে থাকায় এলাকায় প্রকৃতির রুক্ষতা নেই। তবে ভিন্ন চিত্র আশপাশের অনেক গ্রামে। লবণাক্ততার কারণে ওই গ্রামগুলোর মানুষকে খাওয়ার পানির জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়।

এলাকাবাসী জানান, নদীর পানিতে লবণ বেশি, তাই এলাকায় ধান বা অন্য ফসল খুব একটা হয় না। মাছের ঘের বেশি। কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান হয় খুব কম মানুষেরই। বেশির ভাগ মানুষের প্রধান জীবিকা সারা দিন কোমরপানিতে ডুবে রেণুপোনা সংগ্রহ, মাছ ও কাঁকড়া ধরা।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান বলেন, ইউনিয়নটির তিন দিক ঘিরে রয়েছে সুন্দরবন। তাই যেকোনো ছোট-বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবার আগে আছড়ে পড়ে ওই ইউনিয়নে। তিনি বলেন, দক্ষিণ বেদকাশীতে মোট সাড়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। আইলার সময় বাঁধ ভেঙে চার বছরের বেশি সময় পানিবন্দী থাকতে হয়েছে মানুষকে। তখন মাত্র ১০ শতাংশের মতো ঘরবাড়ি টিকে ছিল। তিনি আরও বলেন, আইলার পর আড়াই হাজারের মতো পরিবারকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে।

জোয়ারে জীবন

কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাঠমারচর, কাশিরহাটখোলাসহ অন্তত চারটি গ্রামে মানুষের জীবন জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল। গ্রামগুলোর সঙ্গে সড়কপথের যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। জোয়ারের সময় পানি বাড়লে নৌকা নিয়ে চলাচল করতে হয় তাদের। নদীর পানি বাড়ার আগেই রান্না ও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কাজ সারতে হয়।

প্রতাপনগর বাজার ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি পাকা সড়ক সাতক্ষীরা সদরের দিকে চলে গেছে। একটি জায়গায় (কালভার্ট এলাকা) সড়কটি ভেঙে নদীর পানি প্রবেশ করছে। চলাচলের একমাত্র উপায় ট্রলার বা নৌকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, জোয়ার-ভাটা আসা-যাওয়া করায় ভাঙা বাঁধ এলাকায় গভীর খালের সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেরামত করা সম্ভব নয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ভূমিরূপ একেবারেই নতুন। পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মাটির কণাগুলো একে অপরের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছে, অর্থাৎ ঝুরঝুরে হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভাঙন বাড়ছে, বাঁধগুলো টিকছে না। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অবাধ জোয়ার-ভাটার (টিআরএম) মাধ্যমে ভূমি উঁচু করার সুপারিশ করেন তিনি।

আইলায় বাঁধ ভেঙে চার বছরের বেশি সময় পানিবন্দী থাকতে হয়েছে মানুষকে। আইলার পর আড়াই হাজারের মতো পরিবারকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে।
শামসুর রহমান, চেয়ারম্যান, দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদ

ভালো নেই এলাকাছাড়া মানুষেরা

ঘূর্ণিঝড় আইলার পর বসতবাড়ি হারানো দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের জোড়সিং গ্রামের বাসিন্দা মো. হামিদ এক বছর বাঁধের ওপর টংঘর করে বসবাস করেন। এরপর পরিবার নিয়ে খুলনায় চলে যান। বর্তমানে খুলনা শহরে ভাড়া বাসায় থাকেন। হামিদ রিকশা চালান। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তিনি বলেন, ওই সময় কয়রা থেকে অনেক পরিবার খুলনায় চলে আসে। তাঁদের বেশির ভাগই রিকশা চালান ও দিনমজুরি করেন।

দাকোপের কালাবগি গ্রামের ফকিরের কোনাপাড়ার শেষ মাথায় বসবাস করেন আবুল হোসেন গাজী ও তাঁর বড় ভাই আবু বক্কর গাজী। তাঁদের মা-বাবা বেঁচে নেই। তবে দাদি ও এক প্রতিবন্ধী চাচা তাঁদের সঙ্গে থাকেন। দুই ভাই যেখানে বাস করেন, সেটি মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। ওই দ্বীপের এক পাশে শিবসা ও অন্য পাশে সুতারখালী নদী। অন্য দুই পাশে সুন্দরবন। তাঁদের চলাচলের একমাত্র উপায় নৌকা। যদিও আম্পানের আগে এমনটি ছিল না। আম্পানের তাণ্ডবে হঠাৎ করেই বিচ্ছিন্ন হয় গেছে সেটি।

নৌকা নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘরসহ ছোট উঠানের চারপাশে জোয়ারের পানি থইথই করছে। নদীতে ছোট একটি নৌকা। উঠানে শুকাতে দেওয়া হয়েছে মাছ ধরার জাল। শৌচাগার বলতে যা বোঝায়, তা হলো উঠান থেকে কিছুটা দূরে নদীর মধ্যে ঝুলন্ত একটি গোলপাতার ঘর। সেখানে যেতে বাঁশ দিয়ে সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। উঠানের এক কোনায় কয়েকটি বড় বড় প্লাস্টিকের ড্রামে খাওয়ার পানি রাখা।

আবুল হোসেনের দাদি কুলসুম বেগমের বয়স প্রায় ৮০ বছর। তিনি বলেন, প্রায় ২৫ বছর আগেও ওই এলাকায় তাঁদের ১২ বিঘা জমি ছিল। চিংড়ি চাষ ও নদীতে মাছ ধরে খুব ভালোভাবেই সংসার চলে যেত তাঁদের। একসময় ভাঙন শুরু হলো। এখন কোনোরকমে মাথা গোঁজার জন্য ২০ হাতের মতো জমি ৫ হাজার টাকায় কিনে বসবাস করছেন।

ওই এলাকার মানুষের সুপেয় পানির একমাত্র উৎস বৃষ্টি। বাড়িতে বাড়িতে প্লাস্টিকের ড্রাম থাকে। সেখানে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। ফুরিয়ে গেলে অন্য জায়গা থেকে পানি কিনে আনতে হয় তাঁদের। চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যায় না। দ্রুতগতির একমাত্র বাহন ট্রলার। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ওই এলাকার একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। ভেঙে পড়ছে মসজিদও।

বন্দরের জনপদেও ভাঙনের থাবা

খুলনার কয়রা ও দাকোপ হয়ে এবার রওনা হলাম উপকূলের আরেক জেলা বাগেরহাটের দিকে। সেখানকার মোংলা উপজেলায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরটি রয়েছে। ওই জনপদের চিলা ইউনিয়নের চিলাবাজারের একটি অংশ পশুর নদে বিলীন হয়েছে। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়ও ভাঙনের মুখে রয়েছে। অনেকে নদের তীরে কোনোরকমে ঘর করে বসবাস করছেন। আবার অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, গত ২০ বছরে কালাবগি গ্রামের প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা নদে বিলীন হয়েছে। গুনারী গ্রামের কিছু অংশ শিবসা নদীতে চলে গেছে। এ ছাড়া কয়রা, শ্যামনগর, আশাশুনি মোংলা এলাকার বাঁধ ভেঙেছে ৫০ থেকে ৩০০ মিটারের মতো। নদীবেষ্টিত অন্যান্য এলাকায়ও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

কাজের খোঁজে মানুষ

কয়রা থেকে খুব সহজে মহারাজপুর হয়ে দশাহালিয়া খেয়াঘাট পার হয়ে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় যাওয়া যায়। ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, চারজন মানুষ খেয়া পার হওয়ার জন্য অপেক্ষারত। তাঁদের একজন বাবুল গাজীর (২৩) হাতে একটি মাটি কাটার কোদাল। বাড়ি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের নাকলা গ্রামে। কয়েক দিন আগে কাজের সন্ধানে খুলনায় গিয়েছিলেন। না পেয়ে আবার বাড়ি ফিরেছেন।

বাবুল গাজী বলেন, ‘খুলনায় এখন দিনমজুরের কাজ অনেক কমে গেছে। কয়েক দিন অপেক্ষা করেও কোনো কাজ না পাওয়ায় ফিরে আসতে হয়েছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে সাগরে মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া। এখন মাছ ধরার দলের সঙ্গী হওয়ার চিন্তায় আছি।’

এলাকায় কর্মসংস্থান না থাকায় ইটভাটায় কাজ করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে দেখা যায় কয়রার বিভিন্ন এলাকার মানুষকে। বেশির ভাগ কিশোর ও যুবক প্রতিবছরই ইটভাটায় কাজ করতে যান। এমনকি অনেকেই পরিবার নিয়ে চলে যান ইটভাটায়। অনেকে আগেই সরদারের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে সংসার চালান।

‘দরকার টেকসই বাঁধ’

উপকূলের মানুষের বেঁচে থাকার সমাধান খুঁজতে গিয়ে যে বিষয়টি সবার আগে উঠে এসেছে তা হলো টেকসই ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ। ওই সব এলাকার লোকজন বলছেন, তাঁরা জন্মগতভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে শিখেছেন। এ কারণে বড় ঝড়বৃষ্টি তাঁদের দমিয়ে রাখতে পারে না। কিন্তু নদীর বাঁধ ভেঙে গেলে তাঁরা মনোবল হারিয়ে ফেলেন। কারণ, এটি তাঁদের সর্বস্বান্ত করে দেয়, এটি মোকাবিলার শক্তিও তাঁদের নেই।

নদী বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত মনে করেন, উপকূলবাসীর এলাকা ছাড়ার প্রধান কারণ বসবাসের অনিশ্চয়তা। টেকসই বাঁধ হলে মানুষ অন্তত নিজের ভিটায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। সেই নিশ্চয়তা পেলে এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। আর উপকূল ঘিরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।