অনুমোদন নেই, তবু ভর্তি

অনুমোদনহীন একটি বিভাগে ১৭৫ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিজেও সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ নিয়েছেন।

ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের ভবন।
ছবি: সংগৃহীত

বরিশালের বেসরকারি গ্লোবাল ভিলেজ ইউনিভার্সিটির অনুমোদনহীন একটি বিভাগে তিন বছর ধরে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নামের বিভাগে এই সময়ে ভর্তি করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৭৫। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অব্যবহার ও এককভাবে আর্থিক হিসাব পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনিয়মের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর চিঠি দিলেও এসব অনিয়ম দূর করা হয়নি। মঞ্জুরি কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ফকরুল ইসলাম গত বছরের ১০ অক্টোবর ওই চিঠি দিয়েছিলেন।

ফকরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বছরখানেক আগে এসব অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করে। এরপর তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ার পর তারা দুঃখ প্রকাশ করেছিল। এখনো এসব চলছে কি না, তাঁর জানা নেই।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যয়নরত চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তাঁরা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, আড়াই বছর আগে এই বিভাগে ভর্তি হন তাঁরা। তখন বলা হয়েছিল শিগগিরই বিষয়টি অনুমোদন পাবে। কিন্তু আড়াই বছরেও অনুমোদন মেলেনি। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা করেছেন। সেখানে তাঁদের বলা হয়, যদি বিষয়টি অনুমোদিত না হয়, তাহলে ইলেকট্রিক্যাল বিষয়ের বা অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেখিয়ে সনদ দেওয়া হবে। বর্তমানে অনলাইনে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের চতুর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এসব শিক্ষার্থী।

২০১৭ সালের ১৬ জুলাই অনুমোদন নিয়ে বরিশালে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমানে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। নগরের সিঅ্যান্ডবি সড়কের একটি ভাড়া বাড়িতে এর কার্যক্রম চলে। বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি সূত্র জানায়, ছয়টি বিষয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন নিয়ে ক্যাম্পাসের কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু অনুমোদন না থাকলেও ২০১৮ সালে অবৈধভাবে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এরপর গত তিন শিক্ষাবর্ষে প্রায় ১৭৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। একইভাবে প্রতি বিষয়ে ১০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতি বিষয়ে দ্বিগুণের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ইমরান চৌধুরী বলেন, প্রথমবারই শুধু ওই বিষয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশে বছর দেড়েক আগেই ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করা হয়।

বোর্ডের চেয়ারম্যানই সব

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় প্রায় ১০ কোটি টাকা। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ইমরান চৌধুরী এককভাবে আয়-ব্যয়ের হিসাব পরিচালনা করছেন। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে এক্সিম ব্যাংকের বরিশাল শাখায় ইমরান চৌধুরী ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আমির হোসেনের নামে যৌথভাবে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। পরে ইমরান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের সব টাকা ব্যাংক থেকে তুলে সাউথইস্ট ব্যাংকের বরিশাল শাখায় নিজের নামে খোলা অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন। এরপর থেকে এককভাবে তিনি হিসাব পরিচালনা করছেন। তিনি কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবেও নিয়োগ নিয়েছেন। তবে নিজের নিয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ইমরান চৌধুরী।

সূত্র আরও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদনের সময় মঞ্জুরি কমিশনের শর্ত অনুযায়ী ২০১৭ সালের ৬ ও ১৯ জুন এক্সিম ব্যাংকের বরিশাল শাখায় তিন কোটি টাকার জামানত জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ওই জামানতের অনুকূলে ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ ব্যাংক থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার ঋণ নেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। এক্সিম ব্যাংকের বরিশাল শাখার ব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দীনও জামানতের অনুকূলে ঋণ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে ইমরান চৌধুরী বলেন, জামানতের বিপরীতে তিনি কোনো ঋণ নেননি।

মঞ্জুরি কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ফকরুল ইসলাম বলছেন, জামানতের অনুকূলে ঋণ নেওয়া বেআইনি।

উপাচার্যকে ঢাকায় পাঠানো

২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি শিক্ষার্থী ভর্তি, আর্থিক হিসাবের স্বচ্ছতা আনার তাগিদ দিলে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করেন ইমরান চৌধুরী ও তাঁর সহযোগীরা। ছয় ঘণ্টা আটকে রাখার পর তাঁকে রাতের লঞ্চে করে ঢাকায় পাঠানো হয়।

এ অভিযোগের বিষয়ে ইমরান চৌধুরী বলেন, আর্থিক লেনদেনে কোনো অস্বচ্ছতা নেই। এ নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গেও কোনো ঝামেলা হয়নি।