অপরাধ করলে পরিণতি আকবরের মতোই হবে

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে মো. রায়হান আহমদের মৃত্যুর ঘটনায় এমনিতেই পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ছিল। ফাঁড়ির বরখাস্ত হওয়া ইনচার্জ আকবর হোসেন ভূঁঞার পলায়নে তা আরও বেড়ে যায়। আকবর আর ধরা পড়বেন না, এ রকম ধারণা প্রচলিত ছিল জনমনে। অবশেষে আকবরকে ২৭ দিনের মাথায় গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। এ নিয়ে গতকাল বুধবার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সিলেটের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।
এসপি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

বরখাস্ত হওয়ার পর আকবর হোসেন ভূঁঞা মহানগর পুলিশের হেফাজত থেকে পালিয়েছিলেন। আকবর গ্রেপ্তার হলেন জেলা পুলিশের হাতে। কোন পরিকল্পনায় গ্রেপ্তার করা হলো আকরবকে?

শুরুতে একটি কথা বলে নেওয়া ভালো, নগর পুলিশ বা জেলা পুলিশ বলে ভিন্ন কিছু নেই। আমরা সবাই একই বাহিনীর সদস্য। আকবর পুলিশের একজন সদস্য ছিলেন। ঘটনাটি নিয়ে আমরা চরমভাবে মর্মাহত। আরও মর্মাহত হই আকবরের পলায়নে। পরিকল্পনা আলাদা কিছু ছিল না। সিলেট জেলার বড় একটি অংশ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। কোনো অপরাধ ঘটলেই আমরা অপরাধীদের খুঁজতে সবার আগে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়িয়ে দিই। আকবরের বেলায় সীমান্তের সব থানায় একাধিক ছবি পাঠিয়ে সতর্ক করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে নজরদারি ও সোর্সদের তৎপরতায় আকবর ধরা পড়েছেন। আকবর পালিয়ে কোথায় ছিলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে চাই না। আমাদের বলার বিষয় হচ্ছে, আকবরকে সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি।

প্রশ্ন :

আকবরকে পুলিশে সোপর্দ করার আগে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনি ভারতে ছিলেন। শোনা যাচ্ছে, আশ্রয়দাতাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দেশে এনে আকবরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?

এ নিয়ে আমি কিছু বলব না। এসব বিষয়ে যাঁরা বলছেন, সেটা তাঁদের বিষয়। ভিডিওগুলো আমরা দেখছি। মেইন স্ট্রিম মিডিয়া (মূলধারার গণমাধ্যম) ছাড়া কিছু ফেসবুক মিডিয়া অবাধে সংবেদনশীল অনেক বিষয় তুলে ধরছে। এটা এক ধরনের উপদ্রব। যত্রতত্র লাইভ, কোনো বাছ-বিচার থাকছে না। সীমান্ত এলাকার সংবেদনশীলতাও মানা হয় না। প্রযুক্তির প্রসারে এমন উপদ্রব নানা বিড়ম্বনাও তৈরি করছে। নানা বিষয় উসকে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। অপপ্রচারেই তা হচ্ছে। আমি শুধু বলব, দীর্ঘ নজরদারিতেই আকবরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। আমাদের চেষ্টার সঙ্গে কিছু বিনিময়ও হয়েছে। এই বিনিময় খোলাসা করতে পারব না। গ্রেপ্তার অভিযানে আমাদের সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট থানার পুলিশসহ কিছু সীমান্ত সোর্স, যাঁদের আমি বন্ধু বলি, তাঁরা সহায়তা করেছেন। কানাইঘাটের আরও একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আমাদের সহায়তা করেছেন। আমরা কোনো ক্রেডিট নিতে চাই না, এটা পুলিশের রুটিন কাজ। পুলিশের এই কাজে সহায়তা করায় সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।

আকবর হোসেন ভূঁঞা
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আকবর পালানোর ২৭ দিন পর গ্রেপ্তার হলেন। এই ২৭ দিনই কি আপনাদের নজরদারি চলছিল? এ জন্যই কি বলা হয়েছিল, আকবর পালালেও শনাক্ত হওয়ার অবস্থায় আছেন?

১৪ অক্টোবর থেকে আমরা আকবরকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টায় নামি। এই চেষ্টার শুরুর পর্যায়টা পলাতক আকবরকে শনাক্ত করার পর্যায় ছিল। এরপর আমরা ধাপে ধাপে চেষ্টা অব্যাহত রাখি। তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারব, এই মনোবল ছিল। আমাদের এই চেষ্টা শুধু জেলা পুলিশ নয়, ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত তৎপরতা ছিল। নগর পুলিশ, তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই সবার সহায়তা ও সমন্বয়ের ফলে আকবরকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।

প্রশ্ন :

আকবরকে গ্রেপ্তারের দিন ৯ নভেম্বর সন্ধ্যার পর পুলিশ সুপারের কার্যালয় অভিমুখে হাজার হাজার মানুষের ঢল ছিল। সেই ঢল আপনাকে সামাল দিতে দেখা গেছে। আপনাকে মানুষের ভিড়ে গিয়ে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। মানুষের কী চাওয়া ছিল?

এত দিন মানুষ পুলিশকে গালি দিয়েছিল শুধু একটি কারণে। সেটি হচ্ছে আমাদের হেফাজত থেকে আকবরের পালানো নিয়ে। ধরা পড়ার খবরে মানুষের ঢল থেকে আমাদের প্রতি আরেক আস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রমাণ হয়েছে, অপরাধ করলে কেউ পার পাবে না। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও পুলিশই অভিযোগকারীকে ধরে আইনের আওতায় আনতে পারে। আমি বক্তব্য দিয়েছি, মানুষের ভিড় সামাল দিতে গিয়ে। বলেছি, বিচার নিশ্চিত করতেই আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। মানুষ আমার কথায় আশ্বস্ত হয়েছেন।

রায়হান আহমদ
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

মানুষের এখন চাওয়া আকবরকে পালাতে সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?

দেখুন, পুলিশের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক না কেন, এই পুলিশই মানুষের সবচেয়ে কাছের। এই ঘটনা জনগণের অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। আমরা জনগণের অনুভূতি বুঝতে পেরেছি। বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে সুপারভিশন হচ্ছে। গাফিলতি থাকলে অবশ্যই দেখা হবে। এ ব্যাপারে আসলে আমার বলার কিছু নেই।

প্রশ্ন :

রায়হানের মা বলেছেন, পুলিশি হেফাজতে তাঁর ছেলেই যেন শেষ নাম হয়। আপনি কী বলেন?

দেখুন, আমরা ২ লাখ ১২ হাজার পরিবারের। কোনো সদস্য বিচ্যুত হতেই পারে। তাই বলে গোটা বাহিনীকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। আবারও বলছি, এই ঘটনায় আমরা চরমভাবে মর্মাহত। পুলিশের কাজ ট্রুথলি মানুষের জন্য। মানুষ ও পুলিশে সেতুবন্ধ তৈরি করা, পুলিশকে গণমুখী করা আমাদের কাজ। রিলেশন এক পক্ষে হয় না। উভয় পক্ষে থাকতে হয়। মানুষ ও পুলিশ—এই দুই পক্ষকে নিয়ে অপরাধ নির্মূল করতে গিয়ে চলতে গেলে এক-দুটি বিচ্যুতির ঘটনা ঘটে যায়। এ নিয়ে সম্পর্কেও ফাটল তৈরি হয়। আবার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কও তৈরি হয়। অভিজ্ঞতা থেকে আমার সতর্কতার বার্তা পুলিশ সদস্যদের প্রতি। সেটি হচ্ছে, অপরাধ করলে পরিণতি আকবরের মতোই হবে।