অবরুদ্ধ রংপুর সেনানিবাসে আত্মসমর্পণ

একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন রংপুরের কাহিনি

বিজয়ের মাস

হিলি সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়েছে মিত্রবাহিনী। একের পর এক উত্তরের জনপদ শত্রুমুক্ত করে রংপুরের দিকে এগোচ্ছে তারা। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল নাগাদ মুক্তিযোদ্ধারা পৌঁছায় রংপুর শহরের উপকণ্ঠে। পিছু হটতে থাকা হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায় রংপুর সেনানিবাস।

রংপুর শহর মুক্ত। অথচ শহরজুড়ে একটা চাপা উৎকণ্ঠা। শত্রুরা যে এখনো শহর লাগোয়া সেনানিবাসে।

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে সেই দিনটির কথা স্মরণ করছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর: শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। মানুষজনের চলাচল স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি তখনো। পূর্ব দিক দিয়ে রংপুর শহরে ঢোকার মুখে বাহারকাছনা গ্রাম। ছোট্ট লক্কড়ঝক্কড় একটি ট্রাকে ১০-১২ জনের একটি দল। গায়ে তাঁদের ময়লা কাপড়, আলুথালু চুল, হাতে অস্ত্র। বীরের বেশে শহরের দিকে এগোচ্ছেন তাঁরা। বাড়িঘর থেকে কৌতূহলী লোকজনের উঁকি। কিন্তু পথে নামছে না কেউ। শালবন এলাকায় ট্রাক বিগড়ে যায়। অস্ত্র হাতে একে একে নেমে আসেন তরুণেরা। মানুষজন বুঝে গেল, এঁরা মুক্তিযোদ্ধা। তখন শত শত মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। সবার কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান। ফুল ছিটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানান তাঁরা।

একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর রংপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে সারিবদ্ধভাবে বসে আছে l সৌজন্য: লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ লুৎ​ফুল হক

লক্কড়ঝক্কড় সেই ট্রাকে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটিতে ছিলেন মোছাদ্দেক হোসেন বাবলুও। তখন তাঁর বয়স ১৬ কি ১৭। এখন তিনি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার। জানান, মিত্রবাহিনীর খোলা জিপে করে মুক্তিযোদ্ধারা শহর প্রদক্ষিণ করতে থাকে। মানুষের মাঝে প্রচার করা হয়, হানাদাররা এখন ক্যান্টনমেন্টে বন্দী। তারা আত্মসমর্পণ করেছে। এর উদ্দেশ্য ছিল, শহরের মানুষকে শান্ত রাখা। যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।
একই দিন রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর এলাকা থেকে শহরে ঢোকে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল। সেই দলে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম। এখন তিনি মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার। তিনি জানান, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মিত্রবাহিনী রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে ফেলে।

মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক জানান, ভারতীয় সেনাদের একটি দল মিঠাপুকুর হয়ে রংপুরের মডার্ন মোড়ে (বর্তমান ক্যাডেট কলেজ) এসে সমবেত হয়। এ খবর জানার পর হানাদাররা পিছু হটে রংপুর সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়।

সি এম তারেক রেজার লেখা একাত্তর: বিজয়ের সেই ক্ষণ বইয়ে বিবরণ আছে রংপুরের আত্মসমর্পণ পর্বের। মিত্রবাহিনীর ৬৬ মাউনটেন ব্রিগেড হিলি দিয়ে প্রবেশ করে ৩ ডিসেম্বর ফুলবাড়ী, ৪ ডিসেম্বর চরকাই, ৫ ডিসেম্বর নওয়াবগঞ্জ দখল করে। ১৪ ডিসেম্বর ৬৬ ব্রিগেড ২০২ মাউনটেন ব্রিগেডের সঙ্গে একত্রে রংপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পথে মিঠাপুকুর মুক্ত করে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলের মধ্যে রংপুর শহরের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছায়। শেষ পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় পাকিস্তানি বাহিনী রংপুর থেকে সাদা পতাকা নিয়ে একটি দলকে ২০২ মাউনটেন ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে পাঠায়। ৬৬ মাউনটেন ব্রিগেড কমান্ডার পরের দিন অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বরে রংপুর সেনানিবাসে প্রবেশ করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করান।