অবশেষে উদ্বোধন হচ্ছে সরাইলের বিটঘর বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের বিটঘর বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে নির্মিত নামফলক ও স্মৃতিসৌধ উদ্বোধনের অপেক্ষায়। স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বধ্যভূমির জমিদাতা ও শহীদজায়া মালেকা খাতুন
ছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের বিটঘর বধ্যভূমিতে দেড় বছর আগে শহীদদের স্মরণে নির্মিত নামফলক ও স্মৃতিসৌধ অবশেষে উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। চলতি মাসের ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করা হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জেলা প্রশাসক হায়ত-উদ-দৌলা খান। আর উদ্বোধন করবেন শহীদ পত্নী মালেকা খাতুন (৭৫)।

১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ও ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস পালন উপলক্ষে বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুল হক। উপস্থিত ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা প্রিয়াংকা, সরাইল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মৃধা আহমাদুল কামাল, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবু হানিফ, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রোকেয়া বেগম, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ইসমত আলী, ডেপুটি কমান্ডার আনোয়ার হোসেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সহিদ খালিদ জামিল খান, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি মাহফুজ আলী প্রমুখ।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বিটঘর গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এ গ্রামের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেন। ৩০ অক্টোবর দুপুরে বিটঘর গ্রামের পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। ওই দিন সন্ধ্যার পর দলছুট পাকিস্তানি এক সেনাসদস্যকে হত্যা করেন দুর্গাপুর গ্রামবাসী। গুরুতর আহত করা হয় উপজেলা সদরের মনু মিয়া নামের এক রাজাকারকে। এসব ঘটনার প্রতিশোধ নিতে দুই শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার ৩১ অক্টোবর বিটঘর গ্রামে হানা দিয়ে ৮০ জনকে হত্যা করে। ওই দিন রাজাকারেরা গ্রামে নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, যা ‘বিটঘর গণহত্যা দিবস’ নামে পরিচিত।

যে স্থানে ৮০ জনকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়, সেই ভূমির মালিক ছিলেন শামসুল হক। তিনি শহীদ হওয়ার পর তাঁর মেয়ে নূরজাহান বেগম ও আমিনুল হককে নিয়ে ভীষণ কষ্টে জীবন যাপন করেন স্ত্রী মালেকা খাতুন। স্বামীসহ ৮০ জনের মৃত্যুর স্থানটি স্মৃতি হিসেবে আগলে রেখেছেন মালেকা খাতুন। তাঁর ইচ্ছা স্বামীর রক্তমাখা স্থানটি সংরক্ষণ করে শহীদদের নামে একটা কিছু করা। তাই মালেকা খাতুন ২০০৪ সালে ১৫ শতক জমি বধ্যভূমির নামে লিখে দেন। বর্তমান জেলা প্রশাসক ২০১৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যোগদানের পর বিষয়টি তাঁর নজরে আনেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তিনি শহীদজায়ার ইচ্ছা পূরণ করতে নিজস্ব উদ্যোগে সাড়ে ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে বধ্যভূমিতে আটটি নামফলক ও একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন।

উপজেলা প্রশাসন ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনবার এটি উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করেও তা বাতিল করে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রশাসন তা উদ্বোধনের আর উদ্যোগ নেয়নি। স্মৃতিসৌধের পাশে নির্মাণ করা হয়েছিল উদ্বোধনী স্তম্ভ। সেই স্তম্ভের পাথরেও নাম লেখা হয়েছিল। উদ্বোধন নিয়ে অচলাবস্থার কারণে সেই পাথর স্তম্ভে লাগানো হয়নি।

বিটঘর বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে নির্মিত নামফলক ও স্মৃতিসৌধ উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ৫ মার্চে তোলা
ছবি: বদর উদ্দিন

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সংরক্ষিত নারী আসনের প্রভাবশালী এক সাংসদ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হতে চান। এতে আপত্তি তোলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। বিপত্তি বাধে উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে গ্রামবাসীর আত্মত্যাগের ইতিহাস জানার পাশাপাশি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে বিটঘর বধ্যভূমিটি। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি নির্মাণের পর শহীদ পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ছিল। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার অভাবে এলাকাবাসীর মধ্যে একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছিল, এবার তা দূর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ইসমত আলী ও ডেপুটি কমান্ডার আনোয়ার হোসেন জানান, তাঁরা চান বিটঘর বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হবেন জেলা প্রশাসক, আর উদ্বোধক হবেন শহীদজায়া মালেকা খাতুন।
ইউএনও আরিফুল হক বলেন, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের শেষ বিকেলে বিটঘর বধ্যভূমি উদ্বোধন করা হবে। ওই দিন সন্ধ্যার পরপর শহীদদের স্মরণে বিটঘর বধ্যভূমিতে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হবে।