অবসর কাটাতে বানান হাতপাখা, বিলি করেন মানুষের মাঝে

হাতপাখা তৈরি করে অবসর কাটে শাহজাহান আলীর। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কুরুলিয়া গ্রামে।
ছবি: প্রথম আলো

চার ছেলে, সবাই কর্মব্যস্ত। মা–বাবা দুজনেরই বয়স হয়েছে। তাঁরা এখন অবসরে। ছেলেদের মধ্যে চলে খাওয়াদাওয়া। পোশাকপরিচ্ছদ, এমনকি হাতখরচও ছেলেরাই দেন। বৃদ্ধ বাবা মো. শাহজাহান আলী আর মা খায়রুন নেছার এখন সময় কাটে বাড়িতে বসেই।

অবসরের এই সময়টা পার করতে বৃদ্ধ শাহজাহান আলী বেছে নিয়েছেন পাখা তৈরির কাজ। তবে তা বিক্রির জন্য নয়। বাড়িতে বসে পাখা তৈরি করেন আর মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেন। এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসায়ও পৌঁছে দিয়ে আসেন পাখা। বাড়িতে কোনো আত্মীয়স্বজন এলে উপহার হিসেবে তুলে দেন হাতপাখা। এই পাখা মানুষের মাঝে বিতরণ করে আনন্দ পান তিনি।

শাহজাহান আলীর (৭৫) বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কুরুলিয়া গ্রামে। তিনি পেশায় একজন কৃষক ছিলেন। শাহজাহান আলী জানান, ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ করেন। তাঁর চার ছেলে আর দুই মেয়ে। সবার বিয়ে হয়েছে। চার ছেলের মধ্যে ৩ জন ব্যবসা করেন। গ্রামে এক ছেলের আর বাজারে দুই ছেলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এক ছেলে মাঠের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। মাঠে তাঁদের চাষযোগ্য জমি আছে, যেগুলো তিনি দেখাশোনা করেন।

শাহজাহান আলী জানান, ৫ বছর আগে তাঁর ছেলেরা আনুষ্ঠানিকভাবে সংসার ভাগাভাগি করে নেয়। মাঠের জমাজমিও তিনি ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। এক বাড়িতে পৃথক ঘরে সবাই বসবাস করে। তিনি বলেন, ভাগাভাগির সময় ছেলেরা সিদ্ধান্ত দেয় এখন থেকে মা–বাবা অবসর সময় কাটাবেন। ছেলেদের মধ্যে পালাক্রমে খাওয়াদাওয়া করবেন। পাশাপাশি তাঁদের ইচ্ছায় যেকোনো সময় যেকোনো ছেলের সংসারে খেতে পারবেন। আর বাবার হাতখরচ হিসেবে যা প্রয়োজন, তা ছেলেরা দেবেন। এভাবে নিয়ম করে তাঁরা চলে আসছেন।

শাহজাহান জানান, এই নিয়মে চলার পরও তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর কোনো একটা অভাব থেকে যায়। বুঝতে পারেন তাঁদের এখন সমস্য অবসর সময়টা। তখনই ঠিক করেন এই সময়ে মানুষের জন্য কিছু করবেন। তাঁর বাড়িতে সাতটি তালগাছ রয়েছে। তখন মাথায় চিন্তা আসে অবসর সময় পার করতে এই তালগাছের পাতা থেকে পাখা তৈরি করবেন। যে পাখা তিনি মানুষকে উপহার হিসেবে বিতরণ করবেন।

এরপর ৪ বছর ধরে তিনি পাখা তৈরি করছেন। তাঁর এই কাজে সহযোগিতা করেন স্ত্রী খায়রুন নেছা। ছেলে, ছেলের বউরাও সহযোগিতা করেন।

তিনি জানান, গরমের সময় এলেই তিনি গাছের পাতা কাটেন। এরপর পাতা রোদে শুকিয়ে নেন। শুকনা পাতা কেটে পাখার আকৃতি করে নেন। এবার নিজের ঝাড়ের বাঁশ কেটে শলাকা তৈরি করেন। সেই শলাকা দিয়ে পাখা বেঁধে ফেলেন। এভাবে তিনি গত ৪ বছরে ৫০০ পাখা তৈরি করে মানুষকে দিয়েছেন।

শাহজাহান আলীর বড় ছেলে সানোয়ার আলী জানান, বাবার এই কাজটি তাঁদের খুব ভালো লাগে। অবসর সময়টা পার করতে বাড়িতে বসে হাতের কাজ করেন, যা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেন। এর জন্য কোনো টাকা নেন না। তাঁর এই কাজ ভালো লাগায় তাঁরা সুচ-সুতা কিনে দেন। তিনি বলেন, বাড়িতে আত্মীয় এলে যাওয়ার সময় তিনি একটা পাখা হাতে তুলে দেন। এভাবে বাবার তৈরি পাখা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক প্রান্তে পৌঁছে গেছে।

শাহজাহান আলীর তৈরি পাখা পেয়েছেন বলরামপুর গ্রামের ব্যবসায়ী শাহজাহান আলী। তিনি জানান, শাহজাহানের ছেলে সাইদুর রহমানের পাশে তাঁর দোকান। সেই সূত্রে তিনিও একটি পাখা পেয়েছেন। এই পাখা পেয়ে ভালো লেগেছে। একজন মানুষ বৃদ্ধ বয়সে অবসর সময় কাটাচ্ছেন মানুষের কল্যাণে।

বলরামপুর জামে মসজিদ কমিটির সদস্য গোলাম রব্বানী জানান, তাঁদের মসজিদেও শাহজাহান আলী পাখা দিয়েছেন। যেটা তাঁরা নিয়মিত ব্যবহার করেন। বিদ্যুৎ চলে গেলে এই পাখাই সম্বল হয়ে পড়ে।