অবিক্রীত গরু এখন গলার কাঁটা

পাবনার বেড়ার বৃশালিখা মহল্লার আবু সাঈদ ঢাকার পশুহাটে ৩৩টি গরু নিয়ে গিয়েছিলেন। বিক্রি না হওয়ায় বুধবার ২০টি গরু ফিরিয়ে এনেছেন। আজ বৃহস্পতিবার আবু সাঈদের বাড়িতে।
ছবি: প্রথম আলো

পাবনার বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার আবু সাঈদ কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ও বাকিতে ৩৩টি গরু কিনেছিলেন। ঈদের তিন দিন আগে গরুগুলো তুলেছিলেন ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি হাটে। লোকসানে ১৩টি গরু বিক্রি করতে পারলেও বাকি ২০টি গরু বিক্রি করতে পারেননি। অবশেষে ঈদের দিন রাতে দ্বিগুণ ট্রাকভাড়া দিয়ে গরুগুলো বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছেন।

ঢাকায় আসা-যাওয়া ও পশুর হাটের ভিড়ে গরুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এমনিতেই মাথার ওপর লোকসান ও ঋণের বোঝা, তার ওপর অসুস্থ গরুগুলোর চিকিৎসা ও খাওয়ার খরচের চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এখন গরুর ব্যবসা করে তিনি ভীষণ বিপদে পড়েছেন।

আবু সাঈদ জানালেন, ‘গরুর ব্যবসা করব্যার যায়া আমি শেষ হয়া গেছি। কমপক্ষে ১২ লাখ টাকা লোকসান হয়া যাতেছে আমার। এই অবস্থায় ধারদেনা শোধ করার কোনো উপায়ই দেখতেছি না। ফেরত আনা গরুগুল্যার পেছনে চিকিৎসা ও খাবার বাবদ প্রতিদিন ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ হতেছে। ফেরত গরুগুল্যা এখন গলার কাঁটা হয়া দাঁড়াইছে।’

পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার সব গরু ব্যবসায়ীর অবস্থা এখন আবু সাঈদের মতো। নিজেদের পুঁজির সঙ্গে সুদে ঋণ নিয়ে গরু কিনেছিলেন তাঁরা। লাভের নিয়ে গরুগুলো তুলেছিলেন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন কোরবানির পশুর হাটে। কিন্তু সেখানে লোকসান দিয়েও সব গরু বেচতে পারেননি। ফিরিয়ে আনতে হয়েছে বেশির ভাগ গরু। অনেকেই গরুগুলো বাড়িতে ফেলে রেখে পাওনাদারের ভয়ে ঘরছাড়া হয়েছেন।

শুধু গরু ব্যবসায়ীরাই নন, বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার অনেক খামারি স্থানীয় হাটগুলোতে দাম না পেয়ে লাভের আশায় ঢাকায় গরু নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরাও লোকসানে কিছু গরু বিক্রি করে বাকি গরুগুলো ফিরিয়ে এনেছেন। ঢাকায় গরু নিয়ে যাওয়া-আসা ও থাকার খরচ বাবদ তাঁদের মোটা টাকা ব্যয় হয়ে গেছে।

গরু ব্যবসায়ী ও খামারিরা হিসাব করে জানান, বেড়া ও সাঁথিয়া থেকে ১৫ হাজারের বেশি গরু ঢাকার পশুর হাটে নেওয়া হয়েছিল। এসব গরুর অর্ধেকের বেশিই ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

গরু ফিরিয়ে আনতে গিয়ে গরু ব্যবসায়ী ও খামারিরা পরিবহন–সংকটে চরম বিপাকে পড়েছেন। পরিবহন ব্যবসায়ীরা গরু বিক্রেতাদের কাছে সুযোগ পেয়ে দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। এর ওপর এমন অতিরিক্ত ভাড়াতেও ট্রাক বা নৌকা না পাওয়ায় আজ বৃহস্পতিবারও গরু নিয়ে অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেননি।

বেড়া ও সাঁথিয়া থেকে ঢাকায় গরু নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাকের ভাড়া ছিল ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। অথচ ফেরার সময় এক ট্রাক গরু আনতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে। নৌকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে আরও বেশি।

ঢাকার হাট থেকে গরু নিয়ে ফিরে আসা পাঁচ-ছয়জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেড়া ও সাঁথিয়া থেকে ঢাকায় গরু নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাকের ভাড়া ছিল ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। অথচ ফেরার সময় এক ট্রাক গরু আনতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে। নৌকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে আরও বেশি। ঢাকায় যাওয়ার সময় নৌকাতে প্রতিটি গরুর ভাড়া নেওয়া হয়েছিল এক হাজার টাকা। অথচ সেই নৌকাতেই প্রতিটি ফেরত গরুর ভাড়া নেওয়া হচ্ছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

বেড়া পৌর এলাকার শম্ভুপুর মহল্লার গরু ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা হাটে ৪৯টি গরু নিয়ে গিয়েছিলাম। লোকসানে ৩০টি গরু বেচতে পেরেছি। বাকি ১৯টি গরু নৌকায় ওঠানো হয়েছে। সেগুলো বাড়ি আসার পথে রয়েছে। যাওয়ার সময় নৌকায় প্রতিটি গরুর ভাড়া এক হাজার টাকা করে নিলেও আসার সময় ভাড়া দিতে হচ্ছে সাড়ে চার হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে আমার প্রায় ১৬ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার দেড় শতাধিক ব্যক্তি গরু বেচাকেনার ব্যবসা করেন। তাঁদের বেশির ভাগই চড়া সুদে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গরু কিনেছিলেন। কিন্তু গরু বিক্রি না হওয়ায় গরুগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে পাওনাদারের ভয়ে তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

গরু ব্যবসায়ীরা জানান, কথা ছিল ঢাকার হাট থেকে ফিরে এসেই পাওনাদারের ঋণ শোধ করা হবে। কিন্তু গরু বিক্রি না হওয়ায় দেনা শোধের কোনো উপায়ই তাঁদের কাছে নেই। কিছু গরু বিক্রি হলেও তা লোকসানে বিক্রি করতে হয়েছে। আর বিক্রির টাকার প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয়েছে গোখাদ্য, পরিবহন ব্যয়, শ্রমিকের মজুরি, হাটের খরচসহ বিভিন্ন খাতে। এর ওপর ফিরিয়ে আনা গুরুগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে স্থানীয় হাটে এগুলো বিক্রি করে অর্ধেক দামও পাওয়া যাবে না। এ কারণেই পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে রয়েছেন অনেকে।

সাঁথিয়ার বনগ্রামের এক গরু ব্যবসায়ীর সঙ্গে আজ সকালে কথা হয় বেড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি চায়ের দোকানে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, ২৬টি গরুর ২০টিই তিনি ঢাকা থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। যে ছয়টি বিক্রি করেছেন ঢাকায় যাওয়া-আসা ও গোখাদ্য বাবদ খরচ হয়ে গেছে। এখন পাওনাদারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে রয়েছেন।