অবৈধ জালে মেঘনা দখল, নামতে পারেন না সাধারণ জেলেরা

ভোলার লালমোহন উপজেলায় মেঘনা নদীতে চারপাশে খুঁটি পুঁতে মাছ ধরছেন প্রভাবশালী জেলেরা। সম্প্রতি মেঘনার ৮ নম্বর চর এলাকায়।
ছবি: প্রথম আলো

ভোলার লালমোহন উপজেলায় মেঘনা নদীর প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে অবৈধ খরছি জালে মাছ ধরছে প্রভাবশালী একটি পক্ষ। এতে স্থানীয় ছয় থেকে সাত হাজার সাধারণ জেলে মাছ ধরতে মেঘনায় নামতে পারছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁরা এ খরছি জালের মালিকদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের কাছে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি।

উপজেলার ধলী গৌরনগর ও লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব সীমানায় এই অবৈধ প্রক্রিয়ায় মাছ নিধন চলছে। ধলী গৌরনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে নদীর প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার জলসীমানার চারপাশে খুঁটি পুঁতে মাছ ধরা হচ্ছে। এ খুঁটির বেড়ার চারপাশে জাল বাঁধা। জোয়ারে নদী টইটম্বুর হলে খুঁটির সঙ্গে বাঁধা জাল ওপরে তুলে বেঁধে দেওয়া হয়। ভাটায় পানি কমলে বেড়ার মধ্যখানে জাল টেনে মাছের রেণু-পোনাসহ সব ধরা হচ্ছে। এ জালের নাম খরছি জাল। এ প্রক্রিয়ায় মাছ শিকার সম্পূর্ণ অবৈধ।

জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘ঈদের আগে একটি লিখিত অভিযোগপত্র পেয়েছি, অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সাধারণ জেলেদের পক্ষে বাত্তিরখাল এলাকার মো. জাহাঙ্গীর মিয়া গত ৫ মে লিখিত অভিযোগটি করেন। তিনি লিখেছেন, ধলী গৌরনগর ইউনিয়নের কামারের খাল ও বাত্তির খালের পূর্ব মেঘনার মাঝামাঝি অবস্থানে এবং লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের বুড়িরদোন ঘাট থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে বইস্যার চরের পূর্ব মেঘনা নদীর মধ্যে দুটি খরচি জালের অবস্থান। প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার জলসীমানা দখল করেছে খরছি দুটি। সাধারণ জেলেরা মেঘনার ওই সীমানায় মাছ ধরতে পারছেন না। বছরের মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ জালে মাছ শিকার করা হয়।

লিখিত আবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিস্তীর্ণ জলসীমানা দখল করায় ওই এলাকায় ছোট নৌকায় মাছ ধরা অসহায় জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। নদীতে এমনিতেই মাছ নেই। ছোট ছোট ডিঙির জেলেরা মাছ ধরতে পারছেন না। কারণ, তাঁরা গভীর মেঘনায় মাছ ধরতে যেতে পারে না। সাধারণ জেলেদের পেটে লাথি দিচ্ছেন কয়েকজন প্রভাবশালী। প্রতিদিন ওই এলাকায় ৫-৬ লাখ টাকার মাছ ধরা হচ্ছে।

তজুমদ্দিন উপজেলার মেঘনা নদীতে ৭টি খরছি বসছে কয়েক বছর ধরে। মনপুরায় দুটি, ভোলা ও দৌলতখানেও আছে, তাগো ব্যাপারে কোনো কথা নাই।
আড়তদার আলমগীর হোসেন, খরছিজাল দিয়ে মাছ ধরায় অভিযুক্ত

জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী, যেখানে খরছি জাল পাতা হয়েছে, সেখানে সাধারণ জেলেদের প্রবেশ নিষেধ। এতে ধলী গৌরনগর ও লর্ডহার্ডিঞ্জের প্রায় ৭ হাজার জেলে বেকার হয়ে গেছেন। এর সঙ্গে ধলী গৌরনগর ইউপির চেয়ারম্যান হেদায়াতুল ইসলাম, প্রভাবশালী আলমগীর সিকদার, ফারুক মেম্বার, ইউসুফ মেম্বার, জাহাঙ্গীর মাঝি, শাহে আলম মাঝি, হকার নবী, আলাউদ্দিন, আড়তদার আলমগীর দালাল, নুরনবী মাঝি, কাশেম মাঝি, নোয়াব মহাজন ও নজরুল মাঝি জড়িত।

লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, খরছি জালের কারণে তাঁর এলাকার সাধারণ জেলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

আলাউদ্দিন মাঝি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি চেষ্টা করছি, কিন্তুক ভাগ বসাতে পারিনি। আমার এত্ত ক্ষমতা নেই। এটার সঙ্গে জাহাঙ্গীর মাঝি, মনজু, মান্নু মাঝি, ইউসুফ মেম্বার, নুরনবী, ফারুক মেম্বার, হকার নবীসহ ভেতরে–ভেতরে আরও অনেক বড় মানুষ আছে। আমি নাই।’

আড়তদার আলমগীর বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি খরছির সঙ্গে জড়িত আছি, তজুমদ্দিন উপজেলার মেঘনা নদীতে ৭টি খরছি বসছে কয়েক বছর ধরে। মনপুরায় দুটি, ভোলা ও দৌলতখানেও আছে, তাগো ব্যাপারে কোনো কথা নাই, আমাদের বাত্তির খালে কোনো খরছি ছিল না, আমরা গেল দুই বছর দুইটা বসাচ্ছি। আমরা যদি একটাও না বসাতে পারি, তাহলে ওই বাকিগুলো চলে কীভাবে!’

সাধারণ জেলেদের কষ্টের বিষয়ে ধলী গৌরনগর ইউপির চেয়ারম্যান হেদায়েত ইসলাম বলেন, ‘এডি সব ভুয়া কথা, আমনে আমারে চিনেন না, গত ৪-৫ বছর আগেত্তোন এট্টা খরছি জাল বোইয়ে। এইডা ব্যাকে জানে, এইডা কোনো জাইল্লার ক্ষতিও করে না, কোনো কিছু করে না।’

এই জাল কে বসিয়েছেন জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘অন কী কমু, এইডার লগে এক–দেড় শ লোক জড়িত। না, বসাই নাই (তিনি বসাননি)। আমি হুদা দেখাশোনা করি।’