অভাব জয় করে বড় খামারি

খামারে কাজ করছেন দেবাশীষ কুমার রায়। গতকাল দুপুরে উপজেলা সৈয়দপুর ইউনিয়েনর জাফরনগর এলাকায় ।  প্রথম আলো
খামারে কাজ করছেন দেবাশীষ কুমার রায়। গতকাল দুপুরে উপজেলা সৈয়দপুর ইউনিয়েনর জাফরনগর এলাকায় । প্রথম আলো

বাবা বিজন রায় ব্যবসায় লোকসান দিয়ে একে একে বিষয়সম্পত্তি সব বিক্রি করে দিয়েছেন তখন। পরিবারের বড় ছেলে দেবাশীষ কুমার রায় টাকার অভাবে বাধ্য হলেন লেখাপড়া ছেড়ে দিতে। বাবার পরামর্শেই তখন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিলেন। এরপর শুরু করেন হাঁস-মুরগি ও মাছের চাষ। খামার শুরু করার পর গত ১৫ বছরে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এখন খামার থেকে খরচ বাদ দিয়ে বছরে তাঁর লাভ থাকে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা। ইতিমধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেরা খামারিও হয়েছেন দেবাশীষ।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের জাফরনগর গ্রামে দেড় একর জায়গার ওপর দেবাশীষের বাড়ি ও খামার। এর মধ্যে এক একর জায়গা তিনি বার্ষিক নয় হাজার টাকা দরে ইজারা নিয়েছেন। ‘ভাই ভাই এগ্রো ফার্ম’ নামের খামারে আছে আট হাজার ব্রয়লার মুরগির ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পোলট্রি খামার, দুটি মাছের পুকুর এবং খরগোশ ও শৌখিন পাখির একটি করে খামার।
গতকাল বৃহস্পতিবার দেবাশীষের খামারে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের পাশেই তারজালি দিয়ে ঘেরা ১৫০ ফুট দীর্ঘ ও ২২ ফুট প্রস্থের টিনের ছাউনি দেওয়া দোতলা ঘর। দোতলায় চার শ্রমিক নিয়ে ব্রয়লার মুরগির পরিচর্যা করছিলেন দেবাশীষ। পাশেই বড় পুকুরে মাছের চাষ করেছেন। মাছের খামারের ১০০ গজের মাথায় আরও একটি মাছের খামার রয়েছে। এর পাশেই উঠানে মুরগি, খরগোশ, কবুতর, লাভবার্ড ও কাকাতুয়া পাখির খামার।
দেবাশীষ বলেন, বাবা বিজন রায়ের ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় এসএসসি পাসের পর ২০০৩ সালে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। ২০০৪ সালে বাবার পরামর্শে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালনসহ প্রাথমিক চিকিৎসা ও মাছের চাষ বিষয়ে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ও আত্মীয়–পরিজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে মোট সাড়ে চার লাখ টাকা বিনিয়োগ করে মুরগির খামার শুরু করেন।
দেবাশীষ বলেন, শুরুতেই ৫০০ লেয়ার মুরগি দিয়ে খামার শুরু করেন। দুই বছর পর লেয়ার মুরগি পরিবর্তন করে ব্রয়লার মুরগি পালন শুরু করেন। ২০১৪ সালে এক একর জায়গায় আট হাজার মুরগি ধারণ ক্ষমতার একটি দ্বিতল খামার শুরু করেন।
কিন্তু পরিত্যক্ত খাবার ও বিষ্ঠা অপসারণ দেবাশীষের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। ২০০৫ সালে মাছের খামার, বদ্ধ ঘরে কবুতর পালন, খরগোশ ও পাখি পালন শুরু করেন তিনি। বর্তমানে ৩০টি বিভিন্ন প্রজাতির কবুতর, ১০টি খরগোশ, চারটি লাভবার্ড ও দুটি কাকাতুয়া রয়েছে তাঁর খামারে।
দেবাশীষ জানান, বছরে তিনি আটবার এক দিনের বাচ্চা এনে বড় করে বিক্রি করেন। একেকবারে পাঁচ হাজার থেকে আট হাজারটি এক দিন বয়সী বাচ্চা কেনেন তিনি। একটি বাচ্চার দাম পড়ে ৩০ টাকা। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে বিক্রির উপযোগী হয় মুরগি। এভাবে ১২ মাসে আটবার বাচ্চা এনে বড় করে বিক্রি করেন।
দেবাশীষ বলেন, বছরে খামারে খাবার খরচ ৬২ লাখ টাকা এবং ওষুধ লাগে আড়াই লাখ টাকার। বাচ্চা কেনার পেছনে খরচ হয় ২২ লাখ টাকা। খামারে কর্মরত ১০ জন শ্রমিকের বেতনের পেছনে খরচ হয় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে মাছ ও মুরগির খামার থেকে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা লাভ হয় তাঁর।
খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন দেবাশীষ। পাশাপাশি ১০ জন লোকের কর্মসংস্থানও করেছেন।
দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় দেবাশীষ। বাবা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী। ২০১৪ সালে বিয়ে করেছেন ৩১ বছর বয়সী এই খামারি। ছোট দুই সন্তানের এখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। তাঁদের ভালোভাবেই বড় করে তুলছেন। ছোট ভাই শুভাশীষ রায়কে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বানিয়েছেন। একটু একটু করে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ও করছেন।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, দেবাশীষ বেকার যুবকদের কাছে অনুকরণীয় হতে পারেন। তিনি সফল কর্মীর স্বীকৃতি লাভ করেছেন। এবার জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ খামারির হিসেবে চট্টগ্রাম জেলা থেকে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।