অর্ধেক দামে গরু বিক্রি, কৃষক-খামারির মাথায় হাত

উত্তরাঞ্চলের অন্যতম কোরবানির গবাদিপশুর হাট বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান। এ বছর ক্রেতাদের উপস্থিতি কম থাকায় এ হাটে গরু বিক্রি হয়েছে প্রায় অর্ধেক দামে। বুধবার তোলা ছবি। সোয়েল রানা
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম কোরবানির গবাদিপশুর হাট বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান। এ বছর ক্রেতাদের উপস্থিতি কম থাকায় এ হাটে গরু বিক্রি হয়েছে প্রায় অর্ধেক দামে। বুধবার তোলা ছবি। সোয়েল রানা

সকাল থেকেই ভটভটি ও ট্রাকে করে এবং হেঁটে গরু নিয়ে আসতে থাকেন কৃষক ও খামারিরা। দুপুর গড়াতে না–গড়াতেই বিশাল হাটের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত শুধু গরু আর গরু। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কিন্তু সে তুলনায় হাটে ক্রেতার আনাগোনা খুব কম। তাই দিন শেষে অনেকটা অর্ধেক দামে গরু বিক্রি করে হতাশা নিয়ে হাট থেকে ফিরেছেন অনেক কৃষক-খামারি। অন্যদিকে সস্তায় গরু কিনতে পেরে খুশি ক্রেতারা। এ দৃশ্য আজ বুধবার উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বগুড়ার মহাস্থান গবাদিপশুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়, হাটের ইজারাদার ও গরুর খামারিদের সূত্রে জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে এই কোরবানির হাট থেকে শত শত গরু কিনে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনীসহ দেশের বড় বড় শহরে নিয়ে যেতেন ব্যাপারী ও ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া আগে বগুড়া ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে অনেকে কোরবানির পশু কিনতে এই হাটে আসতেন। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় আগের বছরগুলোর মতো বড় বড় ব্যবসায়ী, ব্যাপারী এবং ক্রেতারা আসেননি। তাই এই হাটে গরুর দাম পড়ে গেছে।

বুধবার মহাস্থান হাটে বড় সাতটি গরু বিক্রির জন্য এসেছিলেন বগুড়া শহরের রাজাবাজারের খামারি আবদুর রহমান। দুপুর পেরিয়ে বিকেল পাঁচটা। ক্রেতার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে অনেকটা বিরক্ত তিনি। শেষে বগুড়া শহরের সূত্রাপুরের ব্যবসায়ী তৌহিদ পারভেজ তাঁর একটি গরু পছন্দ করেন। আবদুর রহমান ৬৫০ কেজি ওজনের গরুটির দাম হাঁকেন দুই লাখ টাকা। শেষে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় গরুটি বিক্রি করে দেন তিনি।

গরুর খামারি আবদুর রহমান বলেন, ‘শনিবার এই হাটে ৬৫০ কেজি ওজনের গরুর দাম ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২ লাখ টাকায় বিক্রির আশায় আজ হাটে তুলেছি। ক্রেতা তেমন নেই। ১ লাখ ২০ হাজারে বিক্রি করে লোকসান হবে। আবার খামারে সাতটা গরু রেখে দিলেও লোকসান গুনতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে লোকসানেই গরু বিক্রি করে দিলাম।’

সস্তায় গরু কিনতে পেরে খুশি ক্রেতা তৌহিদ পারভেজ। তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগেও ৬৫০ কেজি ওজনের এই গরুর দাম ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা ছিল। আজ ক্রেতার চেয়ে গরুর আমদানি বেশি। এ কারণে গরু সস্তায় পেলাম।’

বুধবার বেলা দুইটার দিকে মহাস্থান হাট ঘুরে দেখা গেছে, হাটভর্তি গরু। কিন্তু ক্রেতা খুব একটা নেই। বেচাকেনাও কম। বিক্রেতারা বলছেন, করোনার সংক্রমণে এবার মাথায় হাত তাঁদের। দূরদূরান্ত থেকে ব্যাপারী ও ক্রেতা আসতে পারেনি। তাই গরুর ক্রেতা মিলছে না। এক শ গরুর বিপরীতে ক্রেতা একজন। ফলে ক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম বলেছেন। কোনো উপায় না থাকায় খামারিরাও সেই দামে গরু বিক্রি করে দিয়েছেন।

হাটে বড় একটি গরু বিক্রি করতে এসেছিলেন বগুড়া সদর উপজেলার বামনপাড়া গ্রামের ইমরান হোসেন। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত গরু নিয়ে হাটে বসে থেকেও ক্রেতার দেখা পাননি। তিনি জানালেন, গত বছরের বাজার অনুযায়ী এই গরুর দাম সাত লাখ টাকা। কিন্তু তিন লাখের বেশি কেউ দাম বলে না। অর্ধেক দামে গরু বিক্রি করলে মোটা অঙ্কের লোকসান হবে। তাই তিনি গরু বিক্রি করেননি।

বুধবার হাটে গরু কিনতে এসেছিলেন বগুড়া শহরের উপশহর এলাকার নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ছয় মণ ওজনের একটি গরু কিনেছি ৭০ হাজার টাকায়। গতবার একই ওজনের গরু কিনেছি এক লাখ টাকায়। এবার পেলাম ৭০ হাজার টাকায়। এবার গরুর আমদানি প্রচুর, দামও কম।’

খামারি আবদুল মালেক মহাস্থান হাটে ৪ থেকে ৮ মণ ওজনের আটটি গরু বিক্রি করতে এসেছিলেন। সারা দিন ক্রেতার আশায় বসে থেকে বিকেলের দিকে ৪ মণ ওজনের একটি গরু ৫০ হাজারে এবং ৬ মণ ওজনের একটি গরু ৬৫ হাজারে বিক্রি করেন। মালেক জানালেন, ‘গতবার চার মণ ওজনের পাঁচটি ষাঁড় বিক্রি করেছিলাম ৪ লাখ টাকায়। প্রতি মণ গোশতের দাম ছিল ২০ হাজার (প্রতি কেজি ৫০০) টাকা। এবার গড়ে ১২ হাজার টাকা (প্রতি কেজি ৩০০) মণ দরে গরু বিক্রি করতে হচ্ছে। এ দামে গরু বিক্রি করে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা করে লোকসান হবে।

ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মুখেই ক্ষোভের সুর শোনা গেল হাটে হাসিল আদায় নিয়ে। তাঁদের অভিযোগ, এই হাটে গরু-ছাগলের ক্রেতা–বিক্রেতার কাছ থেকে ইচ্ছেমতো হাসিল আদায় করছেন ইজারাদারের লোকজন।
রাজ্জাক নামের একজন ক্রেতা অভিযোগ করেন, ‘৮০ হাজার টাকায় গরু কিনেছি। আমার কাছ থেকে ৮০০ টাকা আদায় করেছেন ইজারাদার। আবার বিক্রেতার কাছ থেকেও ২০০ টাকা হাসিল আদায় করা হয়েছে। ’একজন ক্রেতা অভিযোগ করেন, হাটে ছাগলের হাসিল আদায় করা হচ্ছে ৬০০ টাকা করে।

হাসিলের কথা বলে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে হাটের ইজারাদার শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারি বিধি অনুযায়ী বিক্রীত মূল্যের আড়াই শতাংশ হাসিল আদায়ের নিয়ম আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, একটি গরুর সরকারনির্ধারিত হাসিল সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকে পশু বিক্রির হাসিল আদায় বেআইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় এবার কোরবানির জন্য সাড়ে তিন লাখ পশুর চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৫৭৭টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু মজুত রয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এবার বাইরের জেলা থেকে ব্যবসায়ী ও ব্যাপারীরা ঠিকমতো আসতে পারেননি।