অসম্পূর্ণ তালিকার সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায়

ছবি: প্রথম আলো

ঢাকাসহ সারা দেশে কোনটি সিএনজিচালিত আর কোনটি ডিজেলচালিত বাস–মিনিবাস সেটা এখনো সরকার সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি। এমনকি এ ধরনের বাস–মিনিবাস কতটি তা–ও জানে না সরকার। এর ফলে সব বাসেই যাত্রীদের কাছ থেকে বর্ধিত ভাড়া আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সরকার ৭ নভেম্বর ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া বৃদ্ধি করে। তখন উল্লেখ করা হয়, বাড়তি ভাড়া সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাসের জন্য প্রযোজ্য হবে না।

ফাইল ছবি

বাংলাদেশে দুই ধরনের সিএনজিচালিত বাস রয়েছে। সিএনজিচালিত বাস হিসেবে আমদানি করা এবং ডিজেলচালিত বাস সিএনজিতে রূপান্তর করে চালানো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষে (বিআরটিএ) নিবন্ধনের সময় যানবাহনটি কোন জ্বালানিতে চলাচল করে তা সংরক্ষণ করা হয়। সিএনজিচালিত হিসেবে আমদানি করা বাসের তথ্য বিআরটিএতে আছে। সূত্র বলছে, ডিজেলচালিত বাস সিএনজিতে রূপান্তর করার পর কোনো পরিবহন মালিকই সেটা বিআরটিএকে জানাননি। ফলে সেগুলো ডিজেলচালিত হিসেবেই কাগজে রয়ে গেছে।

সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, নিবন্ধিত যানবাহনের কোনো কারিগরি, অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে অনুমোদন নিতে হবে। এই বিধান কেউ লঙ্ঘন করলে এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

পরিবহন মালিকেরা তথ্য গোপন করলে ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময়েও বিআরটিএ চাইলে জানতে পারে। কিন্তু বিআরটিএ সূত্র বলছে, তারা এ বিষয়টি এতদিন গুরুত্ব দেয়নি। এখন ডিজেলচালিত যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধির পর ঢাকায় সিএনজি ও ডিজেলচালিত বাস–মিনিবাসের সংখ্যা বের করার উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিএ। তবে চট্টগ্রাম মহানগর ও দূরপাল্লার পথে কত সংখ্যক সিএনজিচালিত বাস–মিনিবাস চলে, সেটা বের করার উদ্যোগ নেই।

জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ডিজেলচালিত যেসব বাস সিএনজিতে রূপান্তর করা হয়েছিল, সেগুলো পুনরায় ডিজেলে চলে যাওয়ার বিষয়টি আসলেই বিআরটিএকে জানানো হয়নি। তিনি বলেন, ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় এটা দেখা হবে। মালিকানা এবং যানবাহনের আকৃতি পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁরা কড়াকড়ি করবেন।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শতে৴ প্রথম আলোকে বলেন, বাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানির মূল্য ও বাসে কী পরিমাণ জ্বালানি ব্যয় হয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডিজেলের চেয়ে গ্যাসের খরচ অনেক কম। সিএনজিচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়া যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। তিনি জানান, ২০১৫ সালে সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া ১০ পয়সা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই বৃদ্ধির ওপর এবার আরেক দফা ভাড়া বৃদ্ধি করিয়ে নিয়েছেন পরিবহন মালিকেরা।

ঢাকার সিএনজিচালিত বাস

বিআরটিএ সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের পর ঢাকা ও এর আশপাশে চালানোর জন্য বেসরকারি পরিবহন মালিকেরা ৪ হাজার ২০০ সিএনজিচালিত বাসের অনুমোদন নেন। এসব বাসের একটা অংশ কয়েক বছরেই অকেজো হয়ে পড়ে। এ ধরনের বাস এখন কতগুলো চলছে তা বের করার চেষ্টা করে বিআরটিএ।

বিআরটিএর হিসাব বলছে, বর্তমানে ঢাকা ও এর আশপাশে ১২৮টি কোম্পানির ৭ হাজার ৩টি বাস-মিনিবাসের চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট) আছে। এর মধ্যে সিএনজিচালিত বাস ৩০৮টি। এটি শুধু সিএনজিচালিত হিসেবে আমদানি করা বাসের সংখ্যা। এর বাইরে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রায় তিন হাজার ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাস সিএনজিতে রূপান্তর করা হয়েছে। এই তথ্য পরিবহন মালিকেরা বিআরটিএকে জানাননি।

ঢাকার এই অসম্পূর্ণ তালিকা তৈরির পর তা পরিবহন মালিক সমিতিকে দিয়েছে বিআরটিএ। তারা গত বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকায় চলাচলকারী ডিজেল ও সিএনজিচালিত বাসে আলাদা আলাদা স্টিকার লাগানো শুরু করে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, সংস্থার কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটরা শুধু স্টিকার লাগানো হয়েছে কি না, সেটা দেখছেন। ইঞ্জিন পরীক্ষা করার আসলে সুযোগ নেই। ঢাকার এসব বাসে স্টিকার লাগানো প্রায় শেষ পর্যায়ে।

১০ নভেম্বর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিল, ঢাকা ও এর আশপাশে সিএনজিচালিত বাসের সংখ্যা ১৯৬টি। গতকাল মঙ্গলবার সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, সিএনজিচালিত বাসের সংখ্যা শ তিনেক হবে। বিআরটিএকে না জানানোর বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে বিষয়টি নিয়ে সেভাবে কেউ ভাবেননি। সিএনজিচালিত বাস চিহ্নিত করে স্টিকার লাগানোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

দেশে সিএনজিচালিত বাস যেভাবে এলো

২০০১ সালের পর পেট্রলচালিত যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তর এবং জ্বালানি আমদানির ওপর চাপ কমানো ও বায়ুদূষণ রোধ করার লক্ষ্যে সিএনজি চালুর সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন স্থাপন এবং যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তরের কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত করতে দেড় শ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।

এর ফলে ২০০৫ থেকে পরবর্তী সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিপুলসংখ্যক সিএনজিচালিত বাস নামে। দূরপাল্লার পথেও এ সময় সিএনজিচালিত বাস নামানো হয়। এমনকি গত এক দশকে সরকারি সংস্থা বিআরটিসিও প্রায় সাড়ে ৫০০ সিএনজিচালিত বাস নামায়।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) দেশে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন ও যানবাহন রূপান্তর কারখানা অনুমোদন দিয়ে থাকে। কোম্পানিটির তথ্য বলছে, গত বছর জুন পর্যন্ত সারা দেশে ৫৯টি সিএনজি রূপান্তর কারখানা চালু আছে। এসব কারখানায় ১৯৮৩ সাল থেকে ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৬টি যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তর করা হয়েছে। সারা দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো। এর মধ্যে অটোরিকশা আছে দুই লাখের কাছাকাছি। তবে সিএনজিচালিত বাসের আলাদা হিসাব নেই।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন মালিকেরা যদি তাঁদের ইচ্ছেমতো সবকিছু করেন, তাহলে আইন রেখে লাভ কী? ঢাকাসহ সারা দেশে সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাস কত চলছে, এর একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা বিআরটিএর থাকা উচিত। নতুবা ভবিষ্যতে গ্যাসের দাম বাড়লে আবারও ঝামেলা হবে। বারবার শুধু যাত্রীরাই কেন প্রতারিত হবেন?