অসুস্থ প্রতিযোগিতা, তবে যাত্রীর লাভ

প্রতিদিন অন্তত চারটি লঞ্চ চলার কথা ঢাকা-পটুয়াখালী নৌপথে। কিন্তু লঞ্চমালিকেরা বাড়তি লাভের জন্য যাত্রীদের জিম্মি করে কখনো দুটি, কখনো তিনটি লঞ্চ চালাতেন। এ নিয়ে যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও কাজ হয়নি। মালিকদের এই অনিয়ম বন্ধে নীবর ছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআইডব্লিউটিএ)। তিন বছর ধরেই চলছিল এ অবস্থা। তবে গত অক্টোবর মাসে এই নৌপথে নতুন একটি লঞ্চ চলতে শুরু করলে পাল্টে যায় পরিস্থিতি।

সাময়িকভাবে যাত্রীদের সুবিধা হলেও এই নৌপথে শুরু হয়েছে অসুস্থ এক প্রতিযোগিতা। নতুন লঞ্চমালিক যাতে ব্যবসা করতে না পারেন, সে জন্য পুরোনো মালিকেরা অভিনব এক কৌশল নিয়েছেন, এটি অনেকটা ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের’ মতো। ভাড়া কমিয়ে যাত্রীদের নিজেদের লঞ্চে টেনে নিচ্ছেন তাঁরা। এতে ক্ষতির মুখে পড়লেও কেউ নতুন লঞ্চকে ছাড় দিতে রাজি নন।

ঢাকা–পটুয়াখালী নৌপথে এত দিন নয়টি লঞ্চ চলাচলের অনুমতি ছিল। গত বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক ঢাকা–পটুয়াখালী নৌপথে লঞ্চ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। এরপর চলতি বছরের ২২ অক্টোবর সেখানে যুক্ত হয় সাউথ বাংলা শিপিং লাইনস লিমিটেডের লঞ্চ ‘রয়েল ক্রুজ–২’। এই লঞ্চ যোগ হওয়ার পর সব কটি লঞ্চ চলাচল শুরু করে। যদিও আগে দিনে চলত দুটি বা তিনটি। ১০টি লঞ্চের মধ্যে ৫টি এক দিন, ৫টি আরেক দিন চলাচল করে। একটি ভাগে রয়েছে এমভি প্রিন্স আওলাদ-৭, এমভি সাত্তার খান-১, এমভি সুন্দরবন-১৪, এমভি জামাল-৫ ও রয়েল ক্রুজ–২ লঞ্চ। আরেকটি ভাগে রয়েছে এমভি সুন্দরবন–৯, এমভি কুয়াকাটা-১, এমভি রাসেল-৪, এমভি কাজল-৭ এবং এমভি এ আর খান। ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে প্রতিদিন পাঁচটি লঞ্চ ছেড়ে যায়। এর মধ্যে কেবল রয়েল ক্রুজ–২ যে ভাগে রয়েছে, সেই ভাগের লঞ্চগুলোই ভাড়া কম নেয়।

এই নৌপথের যাত্রী ব্যবসায়ী মাজহারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ ভাড়া অনেক কমে যাওয়ায় সবাই খুশি। কী কারণে কমল, সেটি বড় কথা নয়, যাত্রীদের এখন লাভ হচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিএ নৌপথের ভাড়া নির্ধারণ করে। প্রথম ১০০ কিলোমিটারের জন্য ভাড়া যাত্রীপ্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা (প্রতি কিলোমিটার)। এরপর প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৪০ পয়সা। নৌপথে ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর দূরত্ব ২৫২ কিলোমিটার। সরকার–নির্ধারিত ভাড়া হিসাবে নিলে এই পথে ভাড়া (ডেক) আসে ৩৮৩ টাকা। আর কেবিনে লঞ্চের শ্রেণিভেদে এই ভাড়া ডেকের ভাড়ার সর্বোচ্চ চার গুণ অর্থাৎ ১ হাজার ৫৩২ টাকা। নতুন লঞ্চ নামার আগে ডেকে জনপ্রতি ৩৫০ টাকা এবং কেবিনে শয্যাপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা করে নেওয়া হতো। যাত্রীরা বলছেন, এখন ডেকের ভাড়া সর্বনিম্ন ৫০ টাকা আর কেবিনে শয্যাপ্রতি ৬০০ টাকা হয়ে গেছে।

এমভি প্রিন্স অব আওলাদ-৭ লঞ্চের মালিক আওলাদ হোসেন প্রথম আলোর কাছে ভাড়া কম নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেন। তবে তাঁর দাবি, অন্য লঞ্চগুলো ভাড়া কম নেওয়া বাধ্য হয়ে তাঁকেও কম নিতে হয়। তিনিও আর্থিক ক্ষতিতে রয়েছেন।

এমভি প্রিন্স অব আওলাদ-৭ লঞ্চের মালিক আওলাদ হোসেন প্রথম আলোর কাছে ভাড়া কম নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেন। তবে তাঁর দাবি, অন্য লঞ্চগুলো ভাড়া কম নেওয়া বাধ্য হয়ে তাঁকেও কম নিতে হয়। তিনিও আর্থিক ক্ষতিতে রয়েছেন।

অন্য মালিকেরা ইচ্ছে করে ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন, এটি উল্লেখ করে গত ১৬ নভেম্বর বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেককে লিখিত অভিযোগ করেছেন সাউথ বাংলা শিপিং লাইনসের চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান। অভিযোগে তিনি বলেছেন, ঢাকা ও পটুয়াখালী উভয় প্রান্তে তাঁর লঞ্চটি সবার শেষে ছেড়ে যায়। আগের চারটি লঞ্চের মালিক ও কর্মচারীরা ভাড়া কমিয়ে ৫০, ১০০ টাকায় যাত্রী পরিবহন করেন। এ কারণে তাঁর লঞ্চে আর যাত্রীই পাওয়া যায় না। দেড় মাসেই তিনি ৫০ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

এ বিষয়ে কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু তাঁর লঞ্চটি চলাচলের দিন অন্য চারটি লঞ্চ সিন্ডিকেট করে বাধা তৈরি করছে। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে লঞ্চ চালানো বন্ধ করে দিলে এই রুটের যাত্রীরা আবারও জিম্মি হয়ে পড়বেন।

পটুয়াখালী–ঢাকা নৌপথে যা হচ্ছে, তা নিচু মানের প্রতিযোগিতা। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো।
কমোডর গোলাম সাদেক , বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান

পুরোনো লঞ্চমালিকদের কর্মচারীরা গত ২ নভেম্বর পটুয়াখালী নদীবন্দরে বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক খাজা সাদিকুর রহমানকে ঘেরাও করেন। এ ঘটনায় পটুয়াখালী সদর থানায় জিডি করেছেন তিনি। এতে উল্লেখ করা হয়, এমভি সত্তার খান-১ এবং এমভি প্রিন্স অব আওলাদ–৭–এর প্রায় ৪০ জন কর্মচারী তাঁকে লাঞ্ছিত করার জন্য ঘেরাও করেন। ভবিষ্যতে টার্মিনালে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, পটুয়াখালী–ঢাকা নৌপথে যা হচ্ছে, তা নিচু মানের প্রতিযোগিতা। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো। তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক পরিদর্শকেরা যখন পরিদর্শনে যান, তখন এরা ভাড়া কম নেয় না। প্রমাণসহ ধরতে পারলে লঞ্চের রুট পারমিট বাতিল করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

শুধু তাঁর লঞ্চটি চলাচলের দিন অন্য চারটি লঞ্চ সিন্ডিকেট করে বাধা তৈরি করছে। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে লঞ্চ চালানো বন্ধ করে দিলে এই রুটের যাত্রীরা আবারও জিম্মি হয়ে পড়বেন।
মো. কামরুজ্জামান, সাউথ বাংলা শিপিং লাইনসের চেয়ারম্যান