‘অস্ত্র’ ছাড়াই ‘যুদ্ধে’ অনলাইন কার্যক্রম

ভৈরবে প্রাথমিকের মোট শিক্ষার্থীর ৫০ শতাংশের বেশি এখনো অনলাইন পাঠদান কার্যক্রমে কোনো মাধ্যমেই যুক্ত হতে পারেনি বলছেন শিক্ষকেরা। এর পেছনে একাধিক কারণের মধ্যে রয়েছে অনেক অভিভাবকের মুঠোফোন না থাকা। আবার অনেকের থাকলেও সেগুলো স্মার্টফোন নয়। নেই ইন্টারনেট। নেই টেলিভিশন। থাকলেও নেই ডিশের সংযোগ বা সংসদ টেলিভিশন চ্যানেলটি। অনেক অভিভাবক একবারের জন্যও শিক্ষকদের ফোন ধরেননি।

এনামুল ও সামি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শ্রীনগর পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের গৃহীত অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে তারা এখনো যুক্ত হতে পারেনি। শুধু এই দুজন নয়, নানা বাধাবিপত্তিতে উপজেলাটিতে শত শত প্রাথমিক শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছে। এই শিক্ষার্থীদের আদৌ যুক্ত করা যাবে কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেননি শিক্ষকেরাও।

আগানগর ইউনিয়নের নবীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির মোট শিক্ষার্থী ৪১৫ জন। শিক্ষক আটজন। অনলাইন কার্যক্রমে কোনোভাবেই তাল মিলিয়ে এগোতে পারছে না বিদ্যালয়টি। কারণ জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘চেষ্টা কম করিনি। কিন্তু অস্ত্র নেই। (অভিভাবকেরা) যুদ্ধ করবেন কী দিয়ে?’ এই ‘অস্ত্র’ বলতে তিনি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সংযোগকে বুঝিয়েছেন।

চেষ্টা কম করিনি। কিন্তু অস্ত্র নেই। (অভিভাবকেরা) যুদ্ধ করবেন কী দিয়ে?
আবদুল্লাহ আল মাসুদ, প্রধান শিক্ষক, নবীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের অবস্থা বিশ্লেষণ করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভৈরবে প্রাথমিকের মোট শিক্ষার্থীর ২৬ দশমিক ৬৮ শতাংশের সঙ্গে এখনো কোনো মাধ্যমেই যুক্ত হওয়া যায়নি। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা ৫০ শতাংশের ওপরে হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকেরা। এর পেছনে একাধিক কারণের মধ্যে রয়েছে অনেক অভিভাবকের মুঠোফোন না থাকা। আবার অনেকের থাকলেও সেগুলো স্মার্টফোন নয়। অনেকের টেলিভিশন নেই। থাকলেও নেই ডিশের সংযোগ বা সংসদ টেলিভিশন চ্যানেলটি। অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক একবারের জন্যও শিক্ষকদের ফোন ধরেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রধান শিক্ষক জানান, ২৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ সংখ্যাটি কাগজে–কলমে। বাস্তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একবারের জন্যও যোগাযোগ করতে পারেনি, এমন শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি হবে। এই সংখ্যা নিয়ে শিক্ষকেরা বিব্রত হলেও প্রতিকারের পথ এই মুহূর্তে অজানা।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে গত বুধবার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে গিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল আলিমকে পাওয়া যায়নি। তিনি কোভিডে আক্রান্ত। তাই কথা হয় উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাদিরা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, অনলাইন কার্যক্রমে শতভাগ সফল হওয়া কঠিন। কারণ, এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে পদে পদে বিপত্তি আর বাধা। অনেক শিক্ষার্থীর বাড়িতে টিভি নেই, অভিভাবকদের স্মার্টফোন নেই। টিভি থাকলেও ডিশ বা স্মার্টফোন থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ নেই। আবার দেখা গেছে, ডিশের সংযোগ রয়েছে, কিন্তু সংসদ টিভি চ্যানেলটি যুক্ত নেই। আবার অনেক পরিবারে স্মার্টফোন থাকলেও কাজে আসছে না। কারণ, অনলাইন পাঠদানের সময় অনেক অভিভাবক তাঁদের নিজ নিজ কাজের প্রয়োজনে মুঠোফোনটি সঙ্গে করে বাইরে যাচ্ছেন।

অনেক সীমাবদ্ধতার পরও উপজেলা পর্যায়ে ভৈরবের চিত্র অনেক ভালো দাবি করে এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, এত দিন পুরোপুরি লেখাপড়ার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকলেও এখন শিক্ষার্থীদের ফোন করে পড়ার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যদিও এখানেও বড় একটি অংশের সঙ্গে এখন পর্যন্ত একবারের জন্যও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।

করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি আছে। শিক্ষার্থীদের পাঠবিমুখতা থেকে ফেরাতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে। কার্যক্রমের আওতায় স্মার্টফোন ছাড়াও বেতার ও টিভির মাধ্যমে পাঠদান উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ভাগ করে শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে পড়া দেওয়া-নেওয়ার কার্যক্রম সচল রাখছেন। একই সঙ্গে মুঠোফোনে কল করে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ব্যাপারে সক্রিয় রাখাও কার্যক্রমের অংশ।

আরও পড়ুন

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন যত শিক্ষার্থী

ভৈরবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯১টি। এসব স্কুলে ২০২০ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২ হাজার ২৩৭। জামালপুর, তেয়ারিচর, কালিকাপ্রসাদ ও গোছমারা—চারটি ক্লাস্টারের মাধ্যমে শিক্ষা দপ্তর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে জামালপুর ক্লাস্টারে বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৪। শিক্ষার্থীসংখ্যা ১১ হাজার ৪৩৫। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ক্লাস্টারের ২ হাজার ৭৪৫ জন শিক্ষার্থীর হদিস পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। অনলাইন ক্লাস শুরুর পর ওই শিক্ষার্থীরা একবারের জন্য কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেনি। এমনকি মুঠোফোনেও যোগাযোগ করা যায়নি তাদের সঙ্গে।

তেয়ারিচর ক্লাস্টারের ৬ হাজার ২০৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে ১ হাজার ৮০০ জন। ক্লাস্টারটিতে বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২২। কালিকাপ্রসাদ ক্লাস্টারে বিদ্যালয় ২২টি। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ হাজার ৪৫০। এর মধ্যে কার্যক্রমের বাইরে থাকার সংখ্যা ১ হাজার ৯৮৮। গোছামারা ক্লাস্টারে বিদ্যালয় ২৩টি। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ হাজার ১৪৬। এর মধ্যে অনলাইন কার্যক্রমের বাইরে আছে ২ হাজার ৭০ জন।

‘চাল-ডাল কেনাই কঠিন, ডেটা কিনব কী দিয়ে?’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন শিক্ষার্থীর তালিকায় পৌর শহরের বিদ্যালয়ের তুলনায় ইউনিয়ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, গ্রামগুলোর বেশির ভাগ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে। মুঠোফোন নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল এবং বেশির ভাগ অভিভাবকের অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোন নেই। গ্রামপর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহও নিরবচ্ছিন্ন নয়। ডিশ–সংযোগও সবার বাড়িতে নেই। আবার ডিশ–সংযোগ থাকলেও সংসদ টিভির চ্যানেলে অনেকে যুক্ত নেই।

যুক্ত হতে না পারার তালিকায় থাকা সাদেকপুর ইউনিয়নের রসুলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যুক্ত হতে হলে অন্তত ১২ হাজার টাকা মূল্যের মুঠোফোন লাগবে। ডেটা কিনতে হবে। এই মুহূর্তে চাল-ডাল কেনাই কঠিন। জীবন রক্ষা না করে শিক্ষা রক্ষা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

যুক্ত হতে হলে অন্তত ১২ হাজার টাকা মূল্যের মুঠোফোন লাগবে। ডেটা কিনতে হবে। এই মুহূর্তে চাল-ডাল কেনাই কঠিন। জীবন রক্ষা না করে শিক্ষা রক্ষা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও কয়েকজন অভিভাবক জানান, এই ধরনের উদ্যোগ সচল থাকার কথা তাঁদের জানা নেই।

পৌর শহরের একটি বিদ্যালয় কালিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রমের হালহকিকত জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক সঞ্চিতা রানী নাহা বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৪৮৯ জন। অনলাইনের নিয়মিত কার্যক্রমে ৫০ জনের বেশি পাই না। ফোনই ধরছে না, এমন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে অনেকে। তবে আমাদের শিক্ষকেরা যোগাযোগ রক্ষায় সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের এই পুরো পরিস্থিতি নিয়ে মুঠোফোনে কথা হয় কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিকের সঙ্গে। বর্তমান চিত্রে তিনি খুশি হতে না পারলেও কার্যক্রমটির অগ্রগতি নিয়ে তিনি নিরাশ নন বলে জানান। সুব্রত কুমার বলেন, ‘করোনা আমাদের সবার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এমন একটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন কার্যক্রমে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফেরানো গেছে—এটাকে সাধুবাদ জানাতে হবে।’ তিনি অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানান।