দুধকুমার নদের ভাঙন
‘অহন কনে যামু, কী করুম’
নাগেশ্বরীর দামাল বড় বাড়ী ও পাশের ধাউরার কুটি গ্রামে এক সপ্তাহে ৫০টি বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে।
‘নদী আমাগরে ফকির বানাইলো গো। বানের পানি আইতেও মারে, যাইতেও মারে। আমরা গরিব মানুষ। অহন কনে যামু, কী করুম, কিছুই বুঝবার পারতাছি না।’ দুধকুমার নদে ভেঙে যাওয়া বসতভিটার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলেন দিনমজুর আবুল কাশেম।
আবুল কাশেমের বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের দামাল বড় বাড়ী গ্রামে। জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। দামাল বড় বাড়ী ও পাশের ধাউরার কুটি গ্রামে এক সপ্তাহে ৫০টি বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার দামাল বড় বাড়ী গিয়ে দেখা যায়, দুধকুমার নদের তাণ্ডব। উজান থেকে আসা পানির স্রোতে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, ফসলি জমি, বাঁধ ও সড়ক। অনেক পরিবার বসতভিটা থেকে ঘরের টিন-চাল, সংসারের জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে। কেউ গাছ বা বাঁশ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামের একমাত্র সরু কাঁচা সড়কে ঘরের চাল, গাছ ও আসবাব স্তূপ করা।
ভাঙনরোধে একটি প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে। সেটি পাস হলে কাজ শুরু হবে।আরিফুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী
ঘর সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দিনমজুর আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘নিজের জাগা-জমি নাই। ঘর সড়কে রাখুম। আমরা এত কষ্টে পরছি, কেউ দেখপার আইলো না। পরিবার গুইলা যে যেখানে পারছে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।’
দুপুরে নদের পাড়ে চৌকির ওপর বসে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভাত খাচ্ছিলেন দিনমজুর হাফিজ উদ্দিন। ভাতের সঙ্গে আলুর ডাল। তিনি বলেন, ‘গাজীপুরে জমিতে কৃষিকাজ করি। করোনার সময় তিন ভাই বাড়ি আইছ। তখন থাইকা বইসা। সকাল থাইকা কিছু খাই নাই। আমার ঘর সরাইছি। বাকিগুলো বিকেলের মধ্যে সরানো হবে।’
গ্রামের পাকা মসজিদও ভাঙনের কবলে। পাশেই মুয়াজ্জিন জসমত আলীর বাড়িও হুমকির মুখে। তিনি বাড়ি সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জসমত আলী বলেন, ‘মসজিদ কমিটিকে বলেছি মসজিদ ভেঙে নেওয়ার জন্য। কিন্তু অনেকে বলছেন, মসজিদের জন্য যদি নদের ভাঙন বন্ধ হয়। সে কারণে অপেক্ষা।’
পুরা এলাকায় ভাঙন চলছে। মানুষের করুণ অবস্থা। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠিয়েছি
দামাল বড় বাড়ী গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে স্লুইসগেট। সেটিও হুমকির মুখে পড়েছে। এরও উত্তরে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারিরঝাড় ইউনিয়নের ধাউরার কুটি গ্রামেও ভাঙন চলছে। বাঁধ-কাম সড়কটি ভাঙনে সরু হয়ে গেছে। যেকোনো সময় চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সড়কের পাশে গাছের নিচে বসেছিলেন সমাস উদ্দিন শেখসহ আরও কয়েক জন। সমাস উদ্দিন শেখ জানান, গত আগস্টে দ্বিতীয় দফা বন্যায় চর ধাউরার কুটি বোল্ডার পাড়া গ্রামটি রাতারাতি বিলীন হয়েছে যায়। সেখানকার ৩৫টি এখন সড়কে বসবাস করছে।
উত্তরে হাজীপাড়া পুরোনো স্লুইসগেট থেকে দক্ষিণে ৩ কিলোমিটার দূরে মুরিয়া গ্রাম পর্যন্ত ভাঙন দেখা দিয়েছে। রায়গঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল ওয়ালিদ বলেন, ‘পুরা এলাকায় ভাঙন চলছে। মানুষের করুণ অবস্থা। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠিয়েছি।’
ইউএনও নুর আহাম্মেদ জানান, ওই এলাকায় ভাঙনের খবর পেয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যানকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তালিকা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, ভাঙনরোধে একটি প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে। সেটি পাস হলে কাজ শুরু হবে।