আইন অমান্য করে ১০ রেস্তোরাঁয় পাখির মাংস বেচাকেনা

হরিপুরের এই রেস্তোরাঁগুলোতে বিক্রি হয় পাখির মাংস। গত শুক্রবার দুপুরে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়।
ছবি : প্রথম আলো

শামুকভাঙা, ডাহুক, বক, ঘুঘু, কুড়া, বালিহাঁস—এমন নানা প্রজাতির পাখি জবাই করে প্রতিদিন রান্না করা হচ্ছে। পথচলতি মানুষ থেকে শুরু করে দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকেরা খেতে আসছেন পাখির মাংস। অথচ বন্য প্রাণী আইন অনুযায়ী, পাখির মাংস বেচাকেনা দণ্ডনীয় অপরাধ।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজারসংলগ্ন ১০টি রেস্তোরাঁয় নিয়মিত পাখির মাংস বিক্রি হচ্ছে। এসব রেস্তোরাঁ সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে অবস্থিত।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে শনিবার দুপুর ১২টায় কথা হয় জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত আজমেরী হকের। এর দুই ঘণ্টা পরই ইউএনও হরিপুর বাজারের রেস্তোরাঁগুলোতে অভিযান চালান। এ সময় রেস্তোরাঁমালিকেরা এগুলোকে হাঁসের মাংস বলে দাবি করেন। পাখির মাংস চেনা বা পরখ করার কোনো উপায় ছিল না। পরে মূল্যতালিকা না টানানোয় চারটি রেস্তোরাঁর মালিককে ৩ হাজার টাকা করে মোট ১২ হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি।

সিলেট-তামাবিল সড়কটি দিয়েই পর্যটনকেন্দ্র গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এবং জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল, রাজবাড়ি ও শ্রীপুরে যেতে হয়। তামাবিল স্থলবন্দরে যাওয়ারও এটাই একমাত্র সড়ক। ফলে সড়কটি দিয়ে চলাচল করেন, এমন ট্রাকচালক ও পর্যটকেরা রেস্তোরাঁগুলোতে খেতে ভিড় করেন। সিলেট শহর থেকেও দল বেঁধে অনেকে ওই রেস্তোরাঁগুলোতে যান পাখির মাংস খেতে।

গত শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, রেস্তোরাঁগুলোর ভেতরে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে সারি সারি গামলা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা। সেসব গামলায় নানা প্রজাতির পাখির মাংস রান্না করে রাখা হয়েছে। মানুষজন ঢাকনা উল্টে দরদাম করছেন। এরপর পছন্দসই মাংস নিয়ে রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছেন। প্রায় প্রতিটি দোকানেই নারী-পুরুষের ভিড় দেখা গেল।

জৈন্তাপুরের হরিপুরে এমন অনেক রেস্তোরাঁয় দেদারছে বিক্রি হয় রান্না করা পাখির মাংস।
ছবি: প্রথম আলো

হরিপুরে যে ১০টি রেস্তোরাঁয় পাখির মাংস বিক্রি হতে দেখা গেছে সেগুলো হচ্ছে সোনার বাংলা রেস্টুরেন্ট, তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট, শাহজালাল রেস্টুরেন্ট, মা-বাবার দোয়া ও শাহ সুন্দর রেস্টুরেন্ট, চাচির দোকান, ভাই ভাই রেস্টুরেন্ট, জনপ্রিয় ড্রাইভার রেস্টুরেন্ট, চুয়াডাঙ্গা রেস্টুরেন্ট, নিউ ড্রাইভার রেস্টুরেন্ট এবং স্বাধীন বাংলা রেস্টুরেন্ট। যেকোনো প্রজাতির পাখির এক টুকরা মাংসের সঙ্গে ভাত, ডাল ও সালাদ ফ্রি। দাম রাখা হয় ১২৫ থেকে ১৫০ টাকা। তবে কুড়ার মাংসের ক্ষেত্রে দাম পড়ে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। সোনার বাংলা রেস্টুরেন্ট এবং তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট ২৪ ঘণ্টা চালু থাকলেও অপর রেস্তোরাঁগুলো সকাল থেকে রাত একটা পর্যন্ত খোলা থাকে।

একাধিক রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, প্রতিটি রেস্তোরাঁয় মোরগ ও কোয়েলের মাংস আছে। এর বাইরে প্রতিদিন দুই থেকে সর্বোচ্চ ছয় প্রজাতির পাখির মাংস পাওয়া যায়। এসব পাখির মাংস তাঁদের সরবরাহ করেন স্থানীয় পাখিশিকারিরা। ফাঁদ পেতে অথবা বিষটোপ দিয়ে শিকারিরা জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটের বিভিন্ন হাওর ও জলাভূমি থেকে পাখি ধরে বাড়িতে নিয়ে যান। পরে জবাই করে পালক ছাড়িয়ে পলিথিনে মুড়িয়ে মাংস রেস্তোরাঁমালিকদের কাছে সরবরাহ করেন। রেস্তোরাঁগুলোতে প্রতিদিন এক থেকে দেড় শ পাখির মাংস বিক্রি হয় বলে খোদ ব্যবসায়ীরাই জানিয়েছেন। অবশ্য শীতকালে পাখি নিধন আরও বাড়ে।

বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী, কোনো পাখি বা পরিযায়ী পাখির মাংস কেনাবেচা অপরাধ। আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের পাশাপাশি উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

শনিবারের অভিযান শেষে জৈন্তাপুরের ইউএনও নুসরাত আজমেরী হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযানের সময় যেসব মাংস পেয়েছি, সেসব হাঁসের মাংস বলে রেস্তোরাঁমালিকেরা দাবি করেন। পাখির মাংস চেনা বা পরখ করার কোনো উপায় নেই। এ ছাড়া তন্ন তন্ন করে কোথাও পাখির পালক পাওয়া যায়নি। যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে সংশ্লিষ্টদের অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করাও সম্ভব হয়নি।’

রেস্তোরাঁগুলোতে রান্না করা পাখির মাংস।
ছবি: প্রথম আলো

গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে রেস্তোরাঁয় খোলামেলাভাবে পাখির মাংস বিক্রির খবর সিলেট শহরের অনেকে জানেন, বললেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অনেকে দল বেঁধে নিয়মিত সেখানে পাখির মাংস খেতে যান। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের জন্য পার্সেলও নিয়ে আসেন।

গত শুক্রবার বেলা দেড়টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত রেস্তোরাঁগুলোর সামনে একাধিক পর্যটকবাহী বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মাইক্রোবাসকে থামতে দেখা গেল। যাত্রীরা নেমেই রেস্তোরাঁয় ঢুকছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, ছুটির দিনে একেকটি রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। গত চার–পাঁচ বছরের ব্যবধানে এই রেস্তোরাঁগুলো চালু হয়েছে।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে অনেক ব্যবসায়ী ও রেস্তোরাঁকর্মী কথা বলতে রাজি হননি। তবে সোনার বাংলা রেস্টুরেন্টের মালিক মো. নুরুদ্দিনের মুঠোফোনে কল করলে তিনি পাখির মাংস বিক্রি করার বিষয়টি প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন। নুরুদ্দিন জানান, আট–নয় মাস আগে তিনি রেস্তোরাঁটি চালু করেছেন। পাখি ছাড়া অন্য পদের তরকারি তিনি বেশি বিক্রি করেন বলে দাবি করেছেন।

সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) রেজাউল করিম চৌধুরীর কার্যালয় মৌলভীবাজার জেলায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হরিপুরে পাখির মাংস বিক্রির বিষয়টি জানা আছে। মৌলভীবাজার থেকে গিয়েও তাঁরা দুই–তিনবার সেখানে অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করেছেন। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে অভিযান চালানো হয়। তাতেও চিত্র বদলায়নি।