আখাউড়ায় ৮৮টি ঘরের নির্মাণকাজ বন্ধের নির্দেশ দিলেন জেলা প্রশাসক

আখাউড়ায় কয়েকটি এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক মো. শাহ্গীর আলম। এসময় একাধিক ঘরের গ্রেড ভিম ও লিংটার ভেঙে দেখেন তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার সাতপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে অনিয়ম পেয়েছে জেলা প্রশাসন। নিয়ম অনুযায়ী রড না দেওয়াসহ অন্যান্য অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ৮৮টি ঘরের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. শাহ্গীর আলম।

গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শনকালে এ নির্দেশনা দেন জেলা প্রশাসক। এ ঘটনায় গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমিন আখাউড়া উপজেলার ছয়টি আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ঘর নির্মাণে অনিয়ম পান। ওই দিনই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশ্রাফ আহমেদ রাসেলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক মো. শাহ্গীর আলম। তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহবুব আলম ও গণপূর্তের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মিজানুর রহমান।

আখাউড়া উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১৬৯টি ঘরের নির্মাণকাজ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক নুরুজ্জামান ভূঁইয়াকে মৌখিকভাবে দেন আখাউড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুমানা আক্তার। উপজেলার রাজাপুর ৩২, চানপুর-১–এ ৪৩, চানপুর-২–এ ১৩, চানপুর-৩–এ ৯, সাতপাড়ায় ২০, খলাপাড়ায় ২৩, ঘাগুটিয়ায় ৮, নিলাখাদে বা কর্মমঠে ১০টি ঘরের নির্মাণকাজ চলছিল। এগুলোর মধ্যে চানপুর-১, রাজাপুর, নিলাখাদ ও খলাপাড়ায় ঘর নির্মাণের কাজ পান উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের আহ্বায়ক ও ঠিকাদার নুরুজ্জামান ভূঁইয়া। একই ভাবে ঘাগুটিয়া, সাতপাড়া ও কর্মমঠ এলাকার ঘর নির্মাণের কাজ পান ঠিকাদার আক্তার হোসেন। কিন্তু চানপুর-২ ও চানপুর-৩ ছাড়া অন্য ছয়টি প্রকল্পের ৮৮টি ঘর নির্মাণে অনিয়ম পেয়ে কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসক।

আখাউড়ায় কয়েকটি এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক মো. শাহ্গীর আলম। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার সাতপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন ইউএনও রুমানা আক্তার। ঘরের নির্মাণকাজ তদরকির দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইফুল ইসলাম, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) তাপস চক্রবর্তী ও উপজেলা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম।

গতকাল সকাল নয়টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত উপজেলার রাজাপুর, চানপুর, সাতপাড়া, খলাপাড়া, ঘাগুটিয়া, কর্মমঠ এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের নির্মাণকাজ পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মো. শাহ্গীর আলম। এ সময় তাঁর সঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমিনসহ তদন্ত কমিটির তিন সদস্য, আখাউড়ার ইউএনও, এসিল্যান্ড, পিআইও, উপজেলা প্রকৌশলীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসক এ সময় সঙ্গে করে শহর থেকে একজন শ্রমিক নিয়ে যান।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে নিয়ম অনুযায়ী, রড, ইট, সিমেন্ট ও বালু দেওয়া হয়েছে কি না, যাচাই করতে প্রতিটি প্রকল্পের একাধিক ঘরের গ্রেড ভিম ও লিংটার ভেঙে দেখেন। এ সময় নির্মাণকাজে অনিয়মের প্রমাণ পায় জেলা প্রশাসক ও তদন্ত কমিটি।

এ সময় তাঁদের সঙ্গে উপস্থিত থেকে দেখা গেছে, গ্রেড ভিমে ১২ মিলিমিটার ব্যাসের চারটি রডের স্থলে কোথাও কোথাও ১০ মিলিমিটারের তিনটি রড এবং লিংটারে ১০ মিলিমিটার ব্যাসের চারটি রডের স্থলে ৮ মিলিমিটারের তিনটি করে রড দেওয়া হয়েছে। অনেক ঘরের লিংটারে কোনো রডই দেওয়া হয়নি। প্রত্যেক ঘরের গ্রেড ভিম ও লিংটারে ছয় ইঞ্চি পরপর রডের রিং থাকার নিয়ম রয়েছে, যা মানা হয়নি।

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট কয়েক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেছেন, উপজেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিটি ঘর থেকে ২৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তাঁদের সম্প্রতি ঈদের কেনাকাটার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন।

জানতে চাইলে ঠিকাদার মো. নুরুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউএনও ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এসব কাজ করছেন। আমি শুধু নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করছি।’

এসব ঘরের নির্মাণকাজে কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা ঘটেনি বলে মন্তব্য করেন ইউএনও রুমানা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই ঠিকাদার পরিচিত। বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁদের কাজ দেওয়া হয়েছিল। ঢালাইয়ের সময় আমরা উপস্থিত থাকতে পারিনি। এটা আমাদের গাফিলতি।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শাহ্গীর আলম বলেন, ‘সাতজন মানুষের জন্য এসব ঘরের নির্মাণকাজে অনিয়ম হয়েছে। এটা জেলার জন্য বদনাম। এ অনিয়মের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইউএনও, এসিল্যান্ড, পিআইও, উপজেলা প্রকৌশলী—কেউই এসব কাজের তদারকি করেননি, পরিদর্শনে যাননি, ঢালাইয়ের সময়ও যাননি। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’

তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, প্রয়োজনে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। এসব বিষয়ে কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ঘরগুলোর নির্মাণকাজ বন্ধ থাকবে।