আগাম রোপণ করা বেশির ভাগ ধানে চিটা

উপজেলার সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে ব্রি-২৮ আবাদ করা হয়। এর মধ্যে অন্তত আড়াই হাজার হেক্টর জমির ধানে কমবেশি চিটা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের হাওরে এবার ব্রি-২৮ ধানে ব্যাপক চিটা হয়েছে। গত সোমবার সকালে অষ্টগ্রাম উপজেলার বড় হাওরেছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলায় জানুয়ারির এক সপ্তাহ পর ব্রি-২৮ ধান রোপণের পরামর্শ দিয়েছিল কৃষি বিভাগ। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ধানের স্বাভাবিক পরাগায়ন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা থেকে কৃষকদের সতর্ক করা হয়েছিল। অন্যথায় ধানে চিটা হওয়ার শঙ্কা ছিল। কৃষি বিভাগের এমন পূর্বাভাসের কথা জানা ছিল উপজেলার দেওঘর ইউনিয়নের কৃষক হাবিবুর রহমানের। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের দুই সপ্তাহ আগেই আধা একর জমিতে ধান আবাদ করেন তিনি। এখন তাঁর জমিজুড়ে শুধু চিটা আর চিটা। এক মণ ধানও পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে তাঁর।

হাবিবুরের মতো অষ্টগ্রামের অনেক কৃষক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের ওই বার্তা শোনেননি। ফলে ব্রি-২৮ ধান লাগানো উপজেলার তিন ভাগের দুই ভাগ জমিতে চিটা হয়েছে। কৃষকদের আগাম ধান রোপণের কয়েকটি কারণ বেরিয়ে এসেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অষ্টগ্রামে এবার বোরোর আবাদ হয়েছে ২৪ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ব্রি-২৮ ধানের জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর। এর মধ্যে অন্তত আড়াই হাজার হেক্টর জমির ধানে কমবেশি চিটা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো কোনো জমির ধান নেক ব্লাস্ট রোগে সংক্রমিত হয়েছে।

ব্যাপকভাবে ফসল হারিয়েছেন এমন অধিকাংশ কৃষকের ধান রোপণের সময়-সংক্রান্ত জটিলতা আছে। আবার যেসব জমিতে চিটা নেই, তার সব কটির পেছনের গল্প সময়মতো রোপণ ও সঠিক পরিচর্যা। প্রতি হেক্টর জমির ব্রি-২৮ ধানের স্বাভাবিক ফলন ছয় থেকে সাত টন। ধারণা করা হচ্ছে, চিটার কারণে অন্তত পাঁচ হাজার টন ফসল কম হতে পারে। এখন চিটার আধিক্যের কারণ হিসেবে কৃষি বিভাগও সময়ের ব্যাপারটিকে সামনে আনছে।

কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, ব্রি-২৮ আগাম ধান। অন্য জাতের ধান চাষে ১৫০ দিন লাগলেও ব্রি-২৮ ধান ১৩৫ দিনেই কাটা যায়। বিশেষ করে নদীতীরবর্তী জমির কৃষকেরা এ ধান চাষ করেন। উজানের ঢল বা নদীর পানি বেড়ে গেলে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। সেই কারণে আগে রোপণ করে ফলন আগে ঘরে তোলার জন্য ব্রি-২৮ আদর্শ। তবে এ ধান স্পর্শকাতরও। বীজতলা থেকে শুরু করে রোপণ পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি সময় ধরে ধরে সম্পন্ন করতে হয়। ব্যতিক্রম হলে ফলন কমে যায়। এবার বীজতলা করতে ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা দিয়েছিল কৃষি বিভাগ। আর রোপণের সময় বলা হয়েছিল, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পর থেকে। এক সপ্তাহ পর থেকে ব্রি-২৮ ধান পুরোদমে কাটা শুরু হবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কৃষকদের আগাম ধান রোপণের দুটি প্রধান কারণ ছিল। প্রথমত বীজতলা থেকে রোপণ পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানির অভাব। পানির মাধ্যম সেচ। উৎস খাল, বিল, নদী। এবার নভেম্বরের শুরু থেকে হাওরের পানি দ্রুত শুকাতে শুরু করে। সম্ভাব্য সেচ দুর্ভোগ কমাতে অনেক কৃষক আগাম বীজতলা ও রোপণ দুই-ই করে ফেলেন। যেসব কৃষক আগাম ধান রোপণ করেছেন, তাঁদের জমিতে চিটা হয়েছে বেশি।

আগাম রোপণের আরও একটি কারণ হলো, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন। জানুয়ারি প্রথম সপ্তাহে অষ্টগ্রাম উপজেলার সব ইউনিয়নে নির্বাচন ছিল। ওই সময় ছিল ব্রি-২৮ রোপণের মূল সময়। কৃষকদের মধ্যে অনেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনে কৃষকদের বড় একটি সংখ্যা অংশ নেন। নির্বাচনের কাজ করার জন্য কৃষকদের বড় একটি অংশ আগাম ধান রোপণ করেন।

এর বাইরে আরও একটি কারণ আছে। হাওরে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি আগ্রাসন। ব্রি-২৮ ধানের জন্য দিনে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৪ আর রাতে ১৮ ডিগ্রি সহনীয়। কিন্তু এবার দিনের তাপমাত্রা ঠিক থাকলেও রাতে কমে যেত। কখনো কখনো কুয়াশা পড়ত। এ ধরনের আবহাওয়ায় ধানের পরাগায়ন ব্যাহত হয়। ধানে চিটা হওয়ার এটিও একটি কারণ।

আগাম ব্রি-২৮ ধান আবাদ করে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার কৃষক সাইদুর রহমান। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। হাওরে এবার তিনি দুই একর জমিতে ব্রি-২৮ ধানের আবাদ করেছিলেন। সেচ ও নির্বাচন–সংক্রান্ত ঘটনায় তিনি আগাম রোপণ করতে বাধ্য হন।

কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলাটির আট ইউপির মধ্যে কাস্তুল ও দেওঘর ইউপিতে চিটার হার সবচেয়ে বেশি। দেওঘর ইউনিয়নে এবার ৮৮২ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রি-২৮ ধান চাষ করা হয় ২২৫ হেক্টর জমিতে।

কাস্তুল ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আদিল ভূঁইয়ার আফসোস, নির্বাচনের অজুহাত দিয়ে শত শত কৃষক যে আগাম রোপণে যেতে পারেন, তা তাঁর আগে জানা ছিল না। কৃষকেরা সচেতন না হলে অপ্রত্যাশিত ফসলহানি এড়ানো সম্ভব নয় বলে মত তাঁর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছাইফুল আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘দিনে গরম আর রাতে কুয়াশা। এসব সমস্যায় ব্রি-২৮ থেকে ভালো ফলন পাওয়া কঠিন।’