‘আগুনের জ্বালা না নিভতেই বানের জ্বালা শুরু হইছে’

আজ বুধবার দিনভর বৃষ্টির কারণে দুর্ভোগের অন্ত নেই রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকার মানুষের
ছবি: প্রথম আলো

দুর্বৃত্তদের আগুনে ঘর পুড়েছে, লুট হয়েছে মালামাল। নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। বাড়ির অদূরেই ধানখেতে বসে রাতের অন্ধকারে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখেছেন তিলে তিলে গড়ে তোলা মাথা গোজানোর ঠাঁই। প্রাণভয়ে প্রতিবাদ করতে না পেরে মুখ চেপে কেঁদেছেন অঝোরে। হামলাকারীরা চলে গেলে ভোরে ফিরেছেন আপন গৃহে। সেখানে পেয়েছেন শুধু পোড়া ছাই।

ঘর হারিয়ে পোড়া মাটিতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তাঁবুতে কয়েকজনের ঠাঁই হয়েছে। কিন্তু আজ বুধবার দিনভর মুষলধারে বৃষ্টির কারণে দুর্ভোগের অন্ত নেই রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকার ধর্ম অবমাননার অভিযোগে উত্তেজিত জনতার আগুনে ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়া মানুষের।

গত রোববার রাতের হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রামের ২১টি ঘর পুড়ে গেছে। ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে অন্তত ৪০টি বাড়িতে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে শতাধিক মানুষ। দুদিনের বৃষ্টি আরও দ্বিগুণ করেছে ঘরপোড়া মানুষের দুর্ভোগ।

কথা হয় ওই গ্রামের ধুলু দাসের (৪৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দাদা, তোমরা এখন হামাক ফকির কবার পান। ভিটামাটি ছাড়া আর কিছু নাই। সন্ত্রাসীরা ঘরদুয়ার পুড়ি দিছে। চাল, ধান, টাকাও লুট করেছে। বউ–ছাওয়া নিয়া মন্দিরোত আছি। পানি–কাদার জন্য কোনটে যাবার পাওছি না। দুই দিন থাকি দ্যাওয়ার পানিত খুবে কষ্টে পড়ছি।’

ধুলু দাসের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ৬০ বছরের বৃদ্ধা সুমতি রানী বলেন, ‘মোরও সুখের সংসার আছলো। আছলো দুইটা গরু। ওরা (হামলাকারীরা) সউগ আগুন নাগে পুড়ি দিছে। থাকার ঘরও ছাই হয়া গেইছে। সাথে গরু দুইটাও। মোর এ্যালা থাকার জায়গা নাই। মাইনষের দেওয়া খাবার খেয়া তাম্বুর ভেতর দুই দিন থাকি আছু। কিন্তু এটেও দ্যাওয়ার পানি ঢুকি গেইছে। থাকা যাওছে না। গোসল, পেশাব-পায়খানারও খুব সমস্যা হইছে।’

হাঁটু গেড়ে গালে হাত দিয়ে কাদাপানিতে তাঁবুর ভেতরে বসে ছিলেন পরিতোষ রায়। তিনি বলেন, ‘যার আত্মীয়স্বজন আছে, তারা সেখানে চলে গেছে। অনেকে মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে। আমার যাওয়ার জায়গা নাই। তাই তাঁবুতে আছি। ঘর, থাকার চৌকি, কাপড়-কাঁথা সব পুড়ে গেছে। সকাল থেকে দ্যাওয়া ভাঙি পানি পড়োছে। সেই পানি তাঁবুর ভেতরোত ঢুকি কাদাতে একাকার হয়া গেইছে। এখানেও থাকা যাওছে না। এমতোন করি কি বাঁচা যায়, কন!’

আজ সরেজমিনে দেখা যায়, পোড়া ভিটায় ঘরদোর হারানো মানুষগুলোর জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পাঁচটি তাঁবু গেড়েছে। সেখানে কয়েকটি পরিবার ঠাঁই নিয়েছে। কিন্তু দিনভর বৃষ্টিতে কাদাপানি জমে একাকার হয়ে গেছে তাঁবুর তলদেশ। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে অনেকে তাঁবুর ভেতরে কাদাপানিতে দাঁড়িয়ে কাটাচ্ছেন দিন। যাঁদের আশ্রয় তাঁবুতে হয়নি, তাঁরা রাত কাটাচ্ছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন মন্দিরে।

তাঁবুর ভেতরে কথা হয় অর্চনা রানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সব হারিয়ে তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছি। আগুনের জ্বালা না নিভতেই বানের জ্বালা শুরু হইছে। দুই দিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। জীবনটা বিষিয়ে উঠেছে। গরিবের কোথাও শান্তি নেই। ভগবান কবে যে গরিবের দিকে চোখ তুলে তাকাবেন!’

আগুনে এসএসসি, জেএসসি ও পিএসসির মূল সনদ হারিয়েছেন স্বপন চন্দ্র রায় (১৮)। তিনি বলেন, ‘আগুনে আমার শিক্ষাসনদ সব পুড়ে গেছে। তিন রাত থেকে চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সরকারিভাবে খাবার রান্না করে দিচ্ছে, তাই খাচ্ছি। আমাদের থাকার খুব কষ্ট হচ্ছে। যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে, রাত পর্যন্ত চলতে থাকলে তাঁবুতেও হাঁটুপানি জমবে।’