আজকে একটা নতুন জীবন পাইছি

তরুণ বয়সে অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি আজও মেলেনি রতন কুমার বিশ্বাসের (৭৬)। নানা খপ্পরে বহু আগেই হারিয়েছেন জায়গাজমি। স্বাধীন দেশে তাই তিনি ছিলেন ভূমিহীন। দীর্ঘদিন থাকতেন বাগেরহাটের শহরতলির গোবরদিয়া গ্রামে নদীতীরের একখণ্ড খাসজমিতে। বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হলে সেখানেও আর থাকতে পারেননি।

উদ্বাস্তু হিসেবে এক বছরের বেশি সময় ধরে ছিলেন সড়কের পাশে ছোট্ট এক খুপরিঘরে। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসার পর তাঁকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় বাগেরহাট সদর উপজেলা প্রশাসন। গতকাল বৃহস্পতিবার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা রতন কুমারকে জমিসহ আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি নতুন ঘর বুঝিয়ে দেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর স্বীকৃতির জন্যও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে এ সময় জানান তিনি।

রতন কুমারের কোনো সন্তান নেই। স্ত্রী মনিরা বেগম (৪৭) শারীরিক প্রতিবন্ধী। সদর উপজেলার গোটাপাড়া ইউনিয়নের কালদিয়া গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। বাবা হরসিদ বিশ্বাস মারা গেছেন মুক্তিযুদ্ধের আগে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। যুদ্ধ শুরু হলে দুই ভাইকে ভারতে রেখে ফিরে আসেন এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হন কমান্ডার রফিকুল ইসলাম খোকনের সঙ্গে। এখন এ দেশে তাঁর আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই।

রতন বিশ্বাস বলেন, ‘সদরের গোটাপাড়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম ছেলেবেলায় তাঁর দুই ক্লাস ওপরে পড়তেন। যুদ্ধ শুরু হলে সে আমাকে প্রায়ই ডাকতেন তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য। আমাদের বাড়ি ছিল নদীর ঘাটে। সন্ধ্যায় ফেরার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। অনেক পরিচিত মানুষ দেখলাম বদলে গেল। দিনের বেলা যাদের সঙ্গে বল খেলেছি। রাতে দেখতাম, তারাই দলবল ধরে ডাকাতি করছে। এসব সহ্য হতো না। আমি রফিকুলের সঙ্গে যোগ দেই।’ এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার গল্প বলছিলেন রতন বিশ্বাস।

কথা বলতে গেলে জড়িয়ে আসে তাঁর। তারপরও কষ্ট করে বলেন, কালদিয়া গ্রামে তাঁদের জায়গাজমি সবই ছিল। এলাকার প্রভাবশালীরা সব দখল করে নিয়েছেন। এরপর সদর উপজেলার কাড়াপাড়া ইউনিয়নের গোবরদিয়া গ্রামে নদীতীরে ঘর বানিয়েছিলেন। ভালো আঁকতে পারতেন। সাইনবোর্ড লিখে দিতেন। নদীপাড়ে নতুন বেড়িবাঁধ তৈরির কাজ শুরু হলে সেই ঘরও চলে যায়। এরপর রাস্তার পাশে যেখানে বসে সাইনবোর্ড লেখা, আঁকাআকি করতেন—সেই টিনের খুপরিঘরেই স্ত্রীকে নিয়ে থাকা শুরু তাঁর।

গতকাল শহরের বাসাবাটি জোড়া মেগনিতলা এলাকায় সড়ক ও জনপদ বিভাগের রাস্তা–লাগোয়া খুপরিঘরে তাঁকে নিয়ে যেতে হাজির পাঁচটি গাড়ি। আশপাশে তখন মানুষের ভিড় লেগে গেছে। উষ্কখুষ্ক প্রবীণ এই মানুষ ততক্ষণে জেনে গেছেন তাঁর জন্য সরকারিভাবে নতুন ঘর ও একখণ্ড জমির বন্দোবস্ত হয়েছে।

ইউএনও ছাড়াও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিন, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভিন, বাগেরহাট–২ আসনের সাংসদ শেখ তন্ময়ের একান্ত সচিব এইচ এম শাহিন মিয়া, ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামানসহ অনেকে এসেছেন তাঁকে নিতে। স্ত্রীসহ তাঁদের নিয়ে সবার গন্তব্য ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের রণভূমি গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে, তাঁর জন্য তৈরি নতুন ঘরে।

উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিন বলেন, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, কোনো মানুষ ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। এরই ধারাবাহিকতায় সাংসদ শেখ তন্ময়ের নির্দেশে রতন কুমার বিশ্বাসকে ঘর উপহার দেওয়া হচ্ছে।

ইউএনও মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রতন কুমার বিশ্বাসের সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গেছে। তাঁর সম্পর্কে প্রথম আমরা জানতে পারি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। তিনি একজন প্রবীণ মানুষ, ভালো আঁকিয়ে। মহাসড়ক–লাগোয়া একটা খুপরিঘরে স্ত্রীকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। বিষয়টি জানার পর জনপ্রতিনিধি, সাংসদের একান্ত সচিবসহ সবাই মিলে আমরা তাঁকে দেখতে যাই। তাঁর সঙ্গে কথা বলে দুটি বিষয় আমরা জানতে পারি। তাঁর নিজের জায়গাজমি, পৈতৃক সম্পতি সব বেদখল হয়ে গেছে এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর কোনো স্বীকৃতি নেই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর একটি যাচাই-বাছাইয়ের প্রতিবেদনও মন্ত্রণালয়ে গেছে।’

ইউএনও মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘তাঁর জায়গাজমি বেদখল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমরা তাঁর জীবনমানের উন্নয়নের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিহীনদের জন্য যেই ঘর, সেখান থেকে একটি ঘর উপহার দিলাম।’

রতন বিশ্বাস বলেন, ‘আমি আজ ৩১ বছর এই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। নতুন জায়গা দেখে আমার ভালো লাগছে। মনে হয়, আমি যেন আজকে একটা নতুন জীবন পাইছি।’