‘আট বছর ধরে বুকে পাথর বেঁধে আছি, মায়ের কষ্ট কি তুই বুঝিস না?’

আট বছর আগে মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া ছেলের ছবি দেখে কাঁদছেন মা খালেদা আক্তার। রোববার বিকেলে কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের গজালিয়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের গজালিয়া গ্রাম। এই গ্রামের এক পাশে জরাজীর্ণ একটি মাটির ঘর। সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গত রোববার বিকেলে কাঁদছিলেন খালেদা আক্তার (৫২)। তাঁর হাতে একটি ছবি। ছবির দিকে তাকিয়ে খালেদা আক্তার বলছিলেন, ‘এত ছেলে বাড়িতে ফিরে আসছে মা-বাবার কাছে, তুই কেন আসছিস না? আট বছর ধরে বুকে পাথর বেঁধে আছি, মায়ের কষ্ট কি তুই বুঝিস না?’ তাঁর ছেলের নাম আক্তার হোসেন (২৩)।

ছবিতে সবুজ গেঞ্জি পরা কয়েকজন তরুণকে বসা অবস্থায় দেখা যায়। সামনের সারির এক তরুণকে নিজের ছেলে উল্লেখ করে খালেদা আক্তার বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিক, চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। আমার ছেলেটা (আক্তার) আট বছর ধরে মালয়েশিয়ার কারাগারে বন্দী। পত্রিকায় লিখলে প্রধানমন্ত্রী দেখতে পাবেন, তখন ছেলেটাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যেত। আমার আক্তারকে ফিরে পেতে চাই। মানব পাচারকারীর শাস্তি চাই।’

২০১৩ সালের ৪ নভেম্বরের ঘটনা। মানব পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে কলেজছাত্র আক্তার হোসেনকে কক্সবাজার উপকূল দিয়ে ট্রলারে তুলে দেয়। এর পর থেকে আক্তার হোসেন নিখোঁজ। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে আক্তার হোসেন সবার বড়। বাবা আবুল হোসেন স্থানীয় একটি কওমি মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক ও একটি মসজিদের ইমাম। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, পরিবারের হাল ধরবে।

আবুল হোসেন বলেন, মানব পাচারকারীরা মালয়েশিয়াতে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ছেলেটাকে সমুদ্রে ঠেলে দিয়েছিল। গ্রামের অনেকে এ রকম মানব পাচারকারীর খপ্পরে পড়েছে, কেউ কেউ মুক্তিপণ দিয়ে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া থেকে ফিরে এসেছে। অনেকে এখনো নিখোঁজ।

মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া কক্সবাজারের কলেজছাত্র আক্তার হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

আট বছর ধরে সন্তানের সন্ধান মিলছিল না উল্লেখ করে আবুল বলেন, সম্প্রতি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মালয়েশিয়ার জেলে বন্দী থাকা বাংলাদেশি কিছু নাগরিকের কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। ছবিগুলো এএনডিপি (আরাকান ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি পার্টি) নামে একটি আইডি থেকে পোস্ট করা হয়।

পোস্টে বলা হয়, বন্দীরা শিগগির ইউএনএইচসিআরের মধ্যস্থতায় জামিন পেতে যাচ্ছে। ছবিতে সামনের সারিতে বসা ছেলেটি আক্তার হোসেন। পেছনের সারিতে বসা আরও দুজনকে চিনতে পারেন এলাকার মানুষ। এর মধ্যে একজন নুরুল ইসলাম (২৫)। তিনি চৌফলদণ্ডির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কালুফকিরপাড়ার নাজির হোসেনের ছেলে। পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন। দালালের খপ্পরে পড়ে তিনিও সাত বছর আগে মালয়েশিয়ায় পাচার হন।

আক্তার হোসেনের মা খালেদা আক্তার বলেন, ‘সবাই বলছিল আক্তার আর বেঁচে নেই। কিন্তু এ কথা আমার বিশ্বাস হতো না। মন বলত, আমার সন্তান বেঁচে আছে, একদিন না একদিন মায়ের কাছে ফিরে আসবে। আজকে (রোববার) ছেলের ছবি দেখে সে কথাই প্রমাণ হলো—আমার ছেলে মরেনি, বেঁচে আছে। আপনারা আমার আক্তারকে এনে দেন, মানব পাচারকারী যারা আমার সন্তানকে পাচার করেছে, তাদের শাস্তি দেন।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে সামনের সারিতে বসা কলেজছাত্র আক্তার হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

ইসলামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর ছিদ্দিক বলেন, ১০ নভেম্বর এএনডিপি নামে একটি আইডি থেকে টুইট বার্তায় মালয়েশিয়ার কারাগারে বন্দী কয়েকটি ছবি পোস্ট করা হয়। ওই ছবিতে কক্সবাজারের ইসলামাবাদ ও চৌফলদণ্ডির তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন দপ্তর ও মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।

ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (গজালিয়া) সদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঈদগাঁও থেকে সমুদ্রপথে ট্রলারে অসংখ্য মানুষকে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে মানব পাচারকারী চক্র। একাধিক ট্রলারডুবির ঘটনায় অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। নিখোঁজ আছেন অনেকে। কিন্তু মানব পাচারকারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। কলেজছাত্র আক্তার হোসেন মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দালালের খপ্পর থেকে রেহাই পাননি।