আট বছরের শিশু মামলার আসামি, দিতে হয় হাজিরা

রাজশাহীর শ্রম আদালতে হওয়া ওই মামলার আসামির নাম মো. জুবাইর আহমেদ। তাঁর বয়স মাত্র আট বছর। অপর একটি মামলায় শিশুটির বাবা জুনাব আলীকে আসামি করা হয়েছে। পবা উপজেলার নওহাটা পৌর বাজারে জুনাব আলীর একটি জুতার দোকান রয়েছে।

রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালতে আট বছরের শিশু জুবাইর আহমেদ বাবার সঙ্গে হাজিরা দিতে এসেছে। রোববার দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালতের সামনে।
প্রথম আলো

বাবা শখ করে দোকানের সাইনবোর্ডে নিজের আট বছরের ছেলের ছবি দিয়েছেন। ছবির নিচে ছেলের নামও লিখে দিয়েছেন। এটাই বাবার জন্য কাল হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে তাঁকে এখন রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালতে হাজিরা দিতে আসতে হচ্ছে। আজ রোববারও বাবা ও ছেলের হাজিরার দিন ছিল।

শিশুটির নাম মো. জুবাইর আহমেদ। তার বাবার নাম মো. জুনাব আলী মণ্ডল। বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌর এলাকায়। জুবাইর স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। নওহাটা পৌর বাজারে জুনাব আলীর একটি জুতার দোকান রয়েছে। দোকানের নাম জে বার্মিজ সুজ। এই দোকানের সাইনবোর্ডের দুই পাশে বাবা শখ করে ছেলের ছবি ব্যবহার করেছেন। ছবির নিচে ছেলের নামও দিয়েছেন।

শিশুটির নাম মো. জুবাইর আহমেদ। তার বাবার নাম মো. জুনাব আলী মণ্ডল। বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌর এলাকায়। জুবাইর স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। নওহাটা পৌর বাজারে জুনাব আলীর একটি জুতার দোকান রয়েছে।

জুনাব আলী জানান, গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় পবা থানার একজন কনস্টেবল তাঁর হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দেন। তিনি খাম খুলে দেখেন তার মধ্যে রাজশাহীর শ্রম আদালতের দুটি সমন। একটি তাঁর নিজের নামে, অপরটি তাঁর ছেলে জুবাইর আহমেদের নামে। এতে তাঁর ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬–এর ৩০৭ ধারার অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁদের গত ২৫ মার্চ নিজেদের অথবা উকিলের মাধ্যমে হাজির হতে বলা হয়েছে। আদালত থেকে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এই আদেশ জারি করা হয়েছে।

আদালতের এই আদেশ পাওয়ার তিনি কিছুই বুঝতে পারেননি। তাঁর কী অপরাধ বা তাঁর শিশুসন্তানেরই–বা কী অপরাধ। প্রথম দিন হাজিরা দিয়ে আদালত থেকে ছেলেসহ তাঁকে জামিন নিতে হয়। তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যেকোনো এক শুক্রবারে নাকি তাঁর দোকান খোলা ছিল। তাতেই শ্রম আইনে অপরাধ হয়েছে।
জুনাব আলী, পবার নওহাটা এলাকার বাসিন্দা ও ওই শিশুর বাবা

জুনাব আলী বলেন, আদালতের এই আদেশ পাওয়ার তিনি কিছুই বুঝতে পারেননি। তাঁর কী অপরাধ বা তাঁর শিশুসন্তানেরই–বা কী অপরাধ। প্রথম দিন হাজিরা দিয়ে আদালত থেকে ছেলেসহ তাঁকে জামিন নিতে হয়। তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যেকোনো এক শুক্রবারে নাকি তাঁর দোকান খোলা ছিল। তাতেই শ্রম আইনে অপরাধ হয়েছে। জুনাব আলী দাবি করেন, তিনি কোনো শুক্রবারেই তাঁর দোকান খোলা রাখেন না। দোকান খোলা অবস্থায় কোনো দিনই তাঁর শ্রম আদালতের কোনো পরিদর্শকের সঙ্গে দেখা হয়নি।

শ্রম আদালতের আইনজীবী এস আলম জামান প্রথম আলোকে বলেন, যে ধারার অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র না দেওয়ার ব্যাপারও আছে। তবে যেহেতু তাঁর দোকানে কোনো শ্রমিক নেই এবং তিনি একা দোকান চালান, সেহেতু শুক্রবার বন্ধের দিনে দোকান খোলার রাখার অভিযোগ আসে। তবে তাঁর (জুনাব আলী) ছেলে দোকানের মালিকও নয়, পরিচালকও নয়। সাইনবোর্ডে ছেলের ছবি থাকার কারণে তাকে মামলার আসামি করা যেতে পারে না।

রোববার বেলা ১১টার দিকে রাজশাহী বিভাগীয় শ্রম আদালত প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, শিশুটি বাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাবা এক কক্ষ থেকে বের হয়ে আরেক কক্ষে যাচ্ছেন, শিশুটিও বাবার পিছে পিছে হেঁটে যাচ্ছে। আদালতকক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য বসার যে জায়গা রাখা হয়েছে, সেখানেও শিশুটি বাবার কোল ঘেঁষে বসে থাকছে। বাইরের লোকজন বুঝতে পারছিলেন না যে এই ছেলেটাও একজন আসামি।

জুনাব আলী প্রথম আলোকে বলেন, একজন আইনজীবী তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, দোষ স্বীকার করে নিলে একটা জরিমানা ধার্য করা হবে। তা পরিশোধ করে দিলেই মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। তাঁকে আর আদালতে আসতে হবে না। জুনাব আলী বলেন, তাঁর শিশুসন্তান কী অপরাধ করেছে, আর সে কী দোষ স্বীকার করবে—এটা তো তিনি মানতে পারছেন না। তিনি বলেন, তিনি দোষ স্বীকার করে জরিমানা দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করবেন না। তিনি মামলায় লড়বেন। অন্যায়ভাবে জরিমানা দেবেন না। দোষও স্বীকার করবেন না।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয়ের পরিদর্শক বাবুল আক্তার বাদী হয়ে বাবা ও ছেলের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে দুটি মামলা করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাবুল আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার দোকান খোলা রাখা হয়, এই মর্মে দুজন শ্রমিক তাঁদের কার্যালয়ে অভিযোগ করেছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ওই বাজার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেদিন দোকানিরা একযোগে তাঁকে ঘিরে ধরেন। একপর্যায়ে পবা থানায় ফোন করলে পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। এই অবস্থায় তিনি মুঠোফোনে কয়েকটি দোকানের সাইনবোর্ডের ছবি তুলেছিলেন। ছবিতে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তাদের জবাব দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। যারা জবাব দেয়নি, তাদের নামে তিনি শ্রম আদালতে মামলা করেছেন।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয়ের পরিদর্শক বাবুল আক্তার বলেন, চিঠির জবাব না দেওয়ায় জুনাব আলী ও তাঁর ছেলের নামে গত ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মামলা করেছেন। এক শিশুকে মামলার আসামি করার ব্যাপারে বলেন, তাঁদের লোকবল নেই। নিরাপত্তার অভাবে তিনি ওই এলাকায় যেতে পারেননি। এ জন্য যাচাই করতে পারেননি যে কে শিশু আর কে বড়। সাইনবোর্ডে যার নাম পেয়েছেন, তার নামেই মামলা করেছেন। তিনি আরও বলেন, শুক্রবার বন্ধের দিনে দোকান খোলা রাখার অভিযোগে এই মামলা দেওয়া হয়েছে। এটা শ্রম আইনের ৩০৭ ধারার মধ্যে পড়ে। তিনি বলেন, শ্রম আইনের অন্য ধারা দিয়ে যে অপরাধগুলো নির্দিষ্ট করা রয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য সব অপরাধকে ৩০৭ ধারার অপরাধ বলে গণ্য করা হয়।