আত্মরক্ষার কৌশল শিখছে শিশু-কিশোর-কিশোরীরা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কারাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে শিশু–কিশোর–কিশোরীরা। গত শুক্রবার বিকেলে সীতাকুণ্ড সরকারি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে চলছে কারাতে প্রশিক্ষণ। তিনটি দলে ভাগ হয়ে ৪৭ জন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। প্রশিক্ষক দেলোয়ার হোসেন। আত্মরক্ষার নানা কৌশল শেখাচ্ছেন তিনি। শিক্ষার্থীরাও সেই কৌশল রপ্তের চেষ্টা করছে। একইভাবে অন্য দল দুটিতেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন দুজন প্রশিক্ষক। মাঠের অদূরে অপেক্ষা করছেন প্রশিক্ষণার্থীদের অভিভাবকেরা।

এভাবে সপ্তাহে এক দিন করে সীতাকুণ্ডের অন্তত ৮০ জন শিশু ও কিশোর-কিশোরী কারাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এতে একদিকে শিশু-কিশোরেরা আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করছে, অন্যদিকে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। শারীরিক গঠনেও এটি অবদান রাখছে। এ কারাতে স্কুলটি পরিচালনা করছে ‘বাংলাদেশ কারাতে কমব্যাট অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি সংস্থা।

শুক্রবার বিকেলে প্রশিক্ষণস্থলে কথা হয় প্রশিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ওরফে ইকবালের সঙ্গে। দেলোয়ারের বাড়ি উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে। তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কর্মরত আছেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে এই স্কুল পরিচালিত হয়।

কারাতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নৌবাহিনীতে চাকরির সুবাদে তিনি কারাতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন। দিন দিন সমাজে নানা অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। কিশোরী ও নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ছেলেরাও সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো মানুষ বিপদে পড়লে উপস্থিত লোকজন সাহস করে এগোতে চায় না। সে জন্য ৬ থেকে ৬০ বছর বয়সী সবার কারাতে শেখা উচিত। এ ছাড়া শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনে এটা ভালো ভূমিকা রাখে। কিন্তু এটা শেখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। বিশেষ করে সীতাকুণ্ডে কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাই তিনি এই উদ্যোগ নেন।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, তিনি মূলত জাপানিজ মার্শাল আর্ট শেখান। ২০১৫ সালের এপ্রিলে মাত্র পাঁচজন শিক্ষার্থী নিয়ে তিনি স্কুল শুরু করেন। এখন পর্যন্ত ৩৩০ জন ভর্তি হয়েছে। অনেকে প্রশিক্ষণ শেষ করেছে। অনেকে ঝরে পড়েছে। বর্তমানে তাঁর ৮০ জন প্রশিক্ষণার্থী আছে। সপ্তাহে এক দিন করে মাসে চারটি ক্লাস নেন তিনি। প্রথম তিন বছর কোনো ভর্তি ফি ও বেতন নেননি। তখন যাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাঁরা আজ প্রশিক্ষিত কারাতে মাস্টার। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থী বাড়তে থাকলে তিনি প্রথম দিকের প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণের কাজে লাগান। তাঁদের কিছু সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এখন ভর্তি ফি নেন ৫০০ টাকা আর মাসিক বেতন ৪০০ টাকা। প্রতি চার মাস পরপর মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর যারা উত্তীর্ণ হয়, তাদের বেল্ট পরিবর্তন হয়।

দেলোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, যখন কোনো প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি হয়, তখন তার বেল্ট সাদা থাকে। এরপর ধীরে ধীরে হলুদ, কমলা, লাল, সবুজ, নীল, বেগুনি, বাদামি ও কালো বেল্টে উত্তীর্ণ হয়। মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে বেল্ট পরিবর্তন হয়। ‍তাঁর ইচ্ছা, সীতাকুণ্ডে আরও অন্তত তিনটি কারাতে প্রশিক্ষণের স্কুল চালু করা।

প্রশিক্ষণার্থীদের একজন নুসরাত জাহান নিশি। সে সীতাকুণ্ড বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। সে জানায়, কারাতে প্রশিক্ষণ নিতে আট মাস আগে ভর্তি হয় সে। প্রথম তার সাদা বেল্ট ছিল। মূল্যায়ন পরীক্ষায় পাস করে এখন হলুদ বেল্ট অর্জন করেছে। ধীরে ধীরে বাকি বেল্টও অর্জন করতে চায় সে। আরেক শিক্ষার্থী অনন্যা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলে, গত ডিসেম্বরে সে কারাতে স্কুলে ভর্তি হয়। দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য সে এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সব মেয়ের এ প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিত বলে সে মনে করে।

সপ্তম শ্রেণির ছাত্র জুনায়েদ জামিল জানাল, সে দুই বছরে সবুজ বেল্ট অর্জন করেছে। প্রথম দিকে এ প্রশিক্ষণ নিতে তার কষ্ট লাগত। ধীরে ধীরে সে অনেক কৌশল রপ্ত করেছে।

মর্জিনা চৌধুরী নামের এক অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ছয় মাস আগে তাদের ভর্তি করিয়েছেন। বাচ্চাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও আত্মরক্ষার জন্যই এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। তারা প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এ জন্য মাসে ৮০০ টাকা বেতন দিচ্ছেন তিনি।