‘আবারও পানিত গেল স্বেচ্ছাশ্রম, টাকা-পয়সা, আশা-ভরসা’

গোবরা পূর্ব চক গ্রামের আসাদুল ইসলাম। চলতি মৌসুমে ছয় বিঘা জমিতে আমনের আবাদ করেছিলেন। হেমন্তে পাকা ধানে উঠোন ভরার স্বপ্ন ভর করেছিল চোখে। জেগেছিল পেট ও পকেটের দুশ্চিন্তা দূর হওয়ার আশা। সেই গুড়ে এখন বালি।

ভেঙে গেছে কপোতাক্ষ নদের রিং বাঁধ। সেখানে মাছ ধরায় ব্যস্ত এক নারী। সোমবার খুলনার কয়রা সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর কয়রা এলাকায়।প্রথম আলো

২ নম্বর কয়রা গ্রামের আবু হুরায়রা বলেন, ‘আগে সব গাছ মরে গেছে। আবার করে মানুষ গাছগাছালি লাগাচ্ছিল। আমিও অনেকগুলো গাছের চারা লাগিয়েছিলাম। গত চার দিনে আবারও যা-তাই হয়ে গেল। কবে আবার বাঁধ আটকাবে তা বলা যাচ্ছে না।’
নতুন করে বাঁধ ভেঙেছে গত ২০ ও ২১ আগস্ট। এ সময় সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও অতিবৃষ্টিতে জোয়ারের চাপ বাড়ে। তার তোড়ে কয়রা ইউনিয়নের রিং বাঁধগুলো টেকেনি। একাধিক জায়গায় ভেঙে যায়। ফলে কয়রা সদরের পাশাপাশি মহারাজপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। আর উত্তর বেদকাশির ডুবে থাকা জায়গাগুলোর পানি আরও বাড়ে। এলাকাবাসীও দমে যাননি। তারা ভেঙে যাওয়া স্থানগুলোতে আবারও রিং বাঁধ দিতে শুরু করেন। এভাবে লোনা পানি আটকানোর চেষ্টা কিছু জায়গায় সফল হয়েছে। তবে সব জায়গা আটকাতে না পারায় জোয়ারের পানি ঢোকা বন্ধ হয়নি।

এখনো পানি ঢুকছে ২ নম্বর কয়রা এলাকার রিং বাঁধের দুটি জায়গা দিয়ে। আর উত্তর বেদকাশি এলাকায় আম্পানে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ এখনো সংস্কার করা হয়নি। জোয়ারের চাপে সেখানে ভাঙা অংশ প্রতিদিন বড় হচ্ছে। এতে সংস্কারকাজ আরও দুরূহ হয়ে পড়ছে। আর কয়রা সদর ইউনিয়নের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এবং মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া গ্রাম এখনো পানির নিচে। কয়রা সদর ইউনিয়নের মধ্যে আদালত চত্বর, কয়রা উপজেলা পরিষদ, থানা, প্রধান সড়ক সব ডুবে আছে। সাধারণ মানুষ এবং কর্মকর্তারা ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বাঁচার তাগিদে কিছু মানুষ এখনো স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধে মেরামতে অংশ নিতে চাচ্ছেন। তবে বেশির ভাগ মানুষ আর বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে চাইছেন না। তাঁদের ভাবনা, শ্রম তাঁরা দিলেও পয়সা তো ঠিকই চলে যাবে ঠিকাদারের পকেটে। এদিকে যারা স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিতে চাইছেন, তাঁরা সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে কাজ করতে পারছেন না। অনেকে কাজে এসে ফিরে যাচ্ছেন। কে ঠিকাদার, তাও জানেন না তাঁরা।
স্থানীয় বাসিন্দা খানজাহান আলী বলেন, মানুষ এখন বিনে পয়সায় শ্রম দিতে চাইছেন না। তারপরও সাধারণ মানুষ আবারও স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কয়েক জায়গায় পানি প্রবেশ আটকে দিয়েছেন। বাঁচার স্বার্থে অনেকে ঠিকাদারকে সহায়তা করতে চাইছেন। তবে তাঁরা পর্যাপ্ত সরঞ্জাম পাচ্ছেন না। বাঁধ মেরামতের জন্য যে বস্তা, বাঁশ, পেরেক, দড়ি দরকার হয় তা পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ কাজ করতে গিয়ে ফিরে আসছেন। এ অবস্থায় দিনে দিনে ভাঙন বড় হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে আবারও বাঁধ ভেঙে গেছে। শোনা যাচ্ছে, ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। তবে কাজ তো শুরু হচ্ছে না। বাজেট নিয়েও বরাবরের মতো লুকোচুরি চলছে।
ইমতিয়াজ উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক, কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, আম্পানের পর মানুষ অনেক কষ্টে পানি আটকেছিলেন। তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁদের দেওয়া অস্থায়ী রিং বাঁধটি কর্তৃপক্ষ তদারকি করে আরও টেকসই করবে। কিন্তু সেরকমটা হয়নি। কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে আবারও বাঁধ ভেঙে গেছে। শোনা যাচ্ছে, ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। তবে কাজ তো শুরু হচ্ছে না। বাজেট নিয়েও বরাবরের মতো লুকোচুরি চলছে।
কয়রা সদর ইউনিয়ন পড়েছে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগ ২-এর আওতায়। বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, ‘ওই এলাকায় আপাতত বাঁধ ঠিকঠাক করার জন্য ঠিকদার নিয়োগ করা হয়েছে। আর স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিয়েছে। এখন প্রতিকূল পরিবেশ। অনুকূল পরিবেশ হলেই তারা কাজ শুরু করবে। এলাকাবাসীর দুর্ভোগের কথা চিন্তা আমরা তাঁদের বারবার অনুরোধও করছি।’