‘আমাগো খোঁজ কেউ লয় না, আপনেগো চাউল-ডাইল দিয়া কয় দিন চলতে পারমু’

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম গ্রামে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে খাদ্যসহায়তা বিতরণ করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালেপ্রথম আলো

‘মোগো কেউ খোঁজ লয় না, বইন্যা আইলেই মোরা পানিতে ভাসি। ঘরে যা থাহে হেইয়াও ভাসাইয়া লইয়া যায় পানিতে। বইন্যার পর কত জাগায় কত কিছু দেয় হুনছি। কিন্তু এহানে পায়রা নদীর পাড়ে কেউ ভ্যাদর-কাদা ভাইঙ্গা আয়না। আমনেরা কষ্ট কইরা আইছেন, খোঁজ লইছেন কিছু খাওন-লওন দিছেন, এতে আমরা খুশি। কয়ডা দিন পোলাপান লইয়া চলতে পারমু।’

প্রথম আলো ট্রাস্টের খাদ্যসহায়তা পেয়ে এভাবে নিজের মনের কথা বললেন রেমিজা আক্তার (৪০)। আজ বৃহস্পতিবার সকালে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার পায়রা নদীর পাড়ে দক্ষিণ-পশ্চিম গ্রামে এ খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়।

এর আগে সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টিতে এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত ওই এলাকার নারী-পুরুষ প্রথম আলোর খাদ্যসহায়তা নিতে মির্জাগঞ্জ গ্রামের দক্ষিণ–পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের ওপর জড়ো হতে থাকেন। বৃষ্টি থামলে প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় দেওয়া খাদ্যসামগ্রী ক্ষতিগ্রস্ত ৭০টি পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেন পটুয়াখালীর বন্ধুসভার সদস্যরা।

প্রতিটি পরিবারকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, দুই কেজি আলু, এক লিটার ভোজ্যতেল, এক কেজি লবণ ও একটি সাবান। এর আগে গতকাল বুধবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা এসব সহায়তা পেয়ে বেজায় খুশি।

রেমিজা বেগমের বাড়ি মির্জাগঞ্জ গ্রামের বেড়িবাঁধের পাশেই। খাদ্যসামগ্রী হাতে পেয়ে তিনি বলেন, ‘এই বান্ধের লইগ্যা সিডরের সময় কোলে গোনে ৩ বছরের মাইয়্যা ভাসাইয়া লইয়া গ্যাছে। ১১ দিন পর প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে ভাঙা গাছের ডালের সাথে মরা অবস্থায় তারে পাইছি। এহনো বুকের মধ্যে ব্যথা দগদগ করে। কত বছরই তো গ্যালো, এহনো এই অবস্থাই আছি। উঁচু বাঁধ আর হইলো না। অমাবইস্যা-পূর্ণিমায় নিচু বাঁধ দিয়া জোয়ারের পানি বাড়লেই পানিতে বাড়িঘর তলাইয়া যায়।’

প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় দেওয়া খাদ্যসামগ্রী ক্ষতিগ্রস্ত ৭০টি পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেন পটুয়াখালীর বন্ধুসভার সদস্যরা। বৃহস্পতিবার সকালে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম গ্রামে
প্রথম আলো

বেড়িবাঁধের পাশেই জোসনা বেগমেরও বাড়ি। তাঁর স্বামী রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উঁচু জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে তাঁর ঘরে পানি উঠেছিল। পানিতে ঘরের ভিটে ধুয়ে নিয়ে গেছে। রিকশার চাকা ঘুরিয়ে যে আয় হয়, তা দিয়ে পেটের ভাত কোনোরকম চলে। কিন্তু ঘর মেরামতের খরচ জোগাড় হয় না তাঁদের। প্রথম আলো ট্রাস্টের চাল-ডাল পেয়ে তিনিও খুব খুশি। তিনি বলেন, ‘মোরা মনে হরছিলাম মোগো কেউ খোঁজ নেবে না। কয়েক দিন দেরিতে হইলেও প্রথম আলো মোগো চাল–ডাল দিয়া সাহায্য হরছে, যা দিয়া কয় দিন ভালো কাটবে।’

পূর্ব মির্জাগঞ্জ গ্রামের রাশিদা বেগম বলেন, ‘আমনেগো দয়ায় যা পাইছি, হেইয়া দিয়া দুই দিন পোলা-মাইয়া লইয়া খাইতে পারমু। কয়েক দিন বাজারে যাওন লাগব না। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে মোগো সব ঘরে পানি ওটছে, ঘরে খাওনদাওনের যা আছিল, সব ভাইস্যা গ্যাছে। এর আগে মোগো কেউ কিছু দিয়া সাহায্য হরে নায়।’

খাদ্যসহায়তা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ–পশ্চিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফরিদ আলম। তিনি বলেন, ‘পায়রা নদীর তীরঘেঁষা এই গ্রামে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যেকোনো দুর্যোগেই পায়রাপারের মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগেও প্রথম আলো এই মির্জাগঞ্জে এসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যসামগ্রী প্রদানসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। প্রথম আলোর এই ধারা অব্যাহত থাকবে আশা করছি।’

খাদ্যসহায়তা বিতরণকালে মির্জাগঞ্জ উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘আসলে প্রথম আলো শুধু পত্রিকাই নয়, তারা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সব সময় মানুষের পাশে থাকে। এভাবে ভবিষ্যতেও পাশে থাকবে, প্রথম আলোর কাছে আমরা এটাই আশা করি।’

এ সময় পটুয়াখালী বন্ধুসভার সভাপতি জাহিদা আক্তার, সহসভাপতি সুস্মিতা মণ্ডল, সাংগঠনিক সম্পাদক তানজিলা রাব্বি সাওদা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিপ্র দাস, দপ্তর সম্পাদক অভিজিৎ গোলদার, যোগাযোগ সম্পাদক ফহিম মুনতাসির ও উপদেষ্টা মেহেদী হাসান, প্রথম আলোর পটুয়াখালী প্রতিনিধি শংকর দাস ও মির্জাগঞ্জ প্রতিনিধি মো. জাকির হোসেন এবং গণমাধ্যমকর্মী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।